দুই বছর আগে মার্চে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ১৮ জেলে। নদীর একটি অংশ থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। এরপর পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক চারজনকে ছেড়ে দিলেও এখনো দেশটির কারাগারে বন্দি রয়েছেন ১৪ জন।
এই ১৪ জেলে কী অবস্থায় আছেন, কেমন আছেন সে সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই পরিবারের সদস্যদের কাছে। আদৌ এরা ছাড়া পাবেন কিনা, তাও জানা নেই। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের অবর্তমানে পরিবারগুলো পড়েছে বিপাকে, দুর্দশা আর অনটন এখন তাদের নিত্য সঙ্গী।
এ পরিবারগুলোর বাস কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায়। নাফনদী সংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকার বাইরের গ্রামটিতে দুই সন্তান নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন মুবিনা খাতুন।
মুবিনার স্বামী আলী আকবর ২০২২ সালের ১৫ মার্চ নাফনদীতে মাছ ধরতে বেরিয়ে আর ঘরে ফেরেননি। সেই থেকে তিনি মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। ফলে দুই সন্তান নিয়ে জীবনধারণে মুবিনাকে বেছে নিতে হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি।
জালিয়াপাড়ায় জরাজীর্ণ বাড়িতেই বসেই সকাল সন্ধ্যার কথা হয় মুবিনা খাতুনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালানোর জন্য বাজারে, স্টেশনে গিয়ে ভিক্ষা করি। সেই টাকা দিয়ে কোনোরকমে অনাহারে-অর্ধাহারে বেঁচে আছি।”
তার অপেক্ষা এখন কেবল স্বামীর ফিরে আসার। যদিও মিয়ানমারের কারাগার কখন আর কীভাবে আলী আকিবর ফিরবেন, তা মুবিনার জানা নেই।
কেবল মুবিনাই নন; জালিয়াপাড়ার আরও ১৩ পরিবারের প্রায় একই অবস্থা।
কারও স্বামী বা কারও সন্তান দুই বছরের বেশি সময় ধরে জেল খাটছেন মিয়ানমারে। বন্দী ১৪ জেলেকে দেশে ফেরাতে সরকারের হস্তক্ষেপ চাইলেন স্বজনরা।
পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে যে চার অপ্রাপ্ত বয়স্ককে দেশে ফেরানো হয়েছিল তাদের একজন রেজাউল করিম। ২০২২ সালের ১৫ মার্চ রেজাউলের বয়স ছিল ১৬ বছর।
সদ্য ১৮ হওয়া রেজাউলের কাছে জানতে চাই সেদিনের ঘটনার কথা।
তিনি বলেন, “আমরা চারটি ট্রলারে নাফনদীতে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ শিকার করছিলাম। হঠাৎ দেখি নদীতে কিছু কাঠ ভেসে যাচ্ছে। তখন সেগুলো ধরার চেষ্টা করি আমরা। হঠাৎই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি স্পিড বোট এসে অস্ত্রের মুখে আমাদের ১৮জনকে ধরে তাদের বিওপিতে নিয়ে যায়।”
সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা তাদের আটকে রাখার পর এক কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়, এমন দাবি করছেন রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, “আমাদের টাকা নেই বলায় তারা আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে প্রায় এক মাস ৯ দিন পর্যন্ত ছিলাম। প্রায় আদালতে তোলা হতো আমাদের, তারপর আবার কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। এরপর একদিন আমাদের চার জনকে আলাদা করে বাকিদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
“আমাদেরকে বুচিদংয়ের একটি জায়গা নিয়ে যায়। ওখানে প্রায় ১৭-১৮ দি থাকার পর আদালতে তোলা হয়। তখন বলা হয় বয়স কম হওয়ায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে চারজনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে।”
এসময় কথা হয় মিয়ানমারে বন্দী দুই ভাই মোহাম্মদ হোসেন ও ইসমাঈলের মা আয়েশা খাতুনের সঙ্গে। দুই ছেলে ছাড়া তার আর কেউ নেই। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এখন মানবেতন জীবন কাটাচ্ছেন।
রেদুয়ান বেগম নামে আরেক নারীর ছেলে ও মেয়ের স্বামী দুই বছর ধরে কারাগারে বন্দি। তার দাবি, এই ১৪ জেলের সাজাভোগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে আবেদন জনান তিনি।
শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল গনি বলেন, সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া ১৪ জেলের সবাই বাংলাদেশি। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের পরিবার এই পাড়ার বাসিন্দা।
জেলেদের ফেরাতে তিনিও সরকারের সহায়তাই চাইলেন।
তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনও দপ্তরের কেউ কথা বলতে রাজী হননি।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিষয়টি পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কূটনৈতিক আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ১৮০ জন সীমান্তরক্ষী ও সেনাসদস্যকে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি মিয়ানমারে আটকা পড়া ১৭০ জন বাংলাদেশিকেও দেশে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরা সবাই মিয়ানমারের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করছেন।”
এই তালিকায় জালিয়াপাড়ার ১৪ জেলেও আছেন কিনা তা নিশ্চিত নন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, তালিকা দেখলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
চলমান সংঘাতের জের ধরে মিয়ানমার থেকে ১৭৭ জন বিজিপি ও তিন সেনা সদস্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের সবাইকে নাইক্ষ্যংছড়ির বিজিবি স্কুল ভবনে রাখা হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বিজিপি সহ ৩৩০ জন। যার মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, চার জন বিজিপি পরিবারের সদস্য, দুজন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য ও চার জন বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। এদের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পাঠানো হয়।