কদিন আগেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাটিতে তাকে জীবিত ধরেই খালাস দেওয়া হলো হাই কোর্টের রায়ে।
২০১৮ সালে বিচারিক আদালতে রায়ে তার যাবজ্জীবন সাজার রায়টি হয়েছিল। পলাতক দেখিয়ে মামলাটিতে তার বিচার হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিসও উঠেছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই আসামিকে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হন্যে হয়ে খুঁজছিল; তখন খবর আসে ঢাকায় থেকেই ২০২১ সালে মারা যান এই বিএনপি নেতা, তাকে কবরও দেওয়া হয় সাভারে।
দৈনিক মানবজমিন তখন এক প্রতিবেদনে এই দাবি তোলার পর তা নিয়ে সংশয় কাটছিল না সবার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার মেয়ে সামিরা তানজিম চৌধুরীর একটি রিট আবেদনে হাই কোর্ট মৃতদেহ কবর থেকে তুলে ডিএনএ পরীক্ষার আদেশ দিয়েছিল।
সেই পরীক্ষার ফল এসেছে। সামিরার ডিএনএর সঙ্গে সাভারের কবরের ওই লাশের ডিএনএ নমুনা মিলেছে।
সেই প্রতিবেদন পেয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার হারিছ চৌধুরীর মেয়েকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্থানে বাবার লাশ দাফনের অনুমতি দিয়েছে।
আদালতে দেওয়া ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে সিআইডি বলেছে, “ডিএনএ পরীক্ষায়, অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত হতে একজন পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। ডিএনএ পরীক্ষায় সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় যে, অজ্ঞাত মৃতদেহ, সামিরা তানজীন ওরফে সামিরা তানজীন চৌধুরীর (হারিছ চৌধুরীর) জৈবিক পিতা।”
ফলে মৃত্যুর তিন বছর পর নিশ্চিত হওয়া গেল, ২০২১ সালে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর জালালাবাদ এলাকার জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসার কবরস্থানে মাহমুদুর রহমানের নামে দাফন করা লাশটি হারিছ চৌধুরীরই ছিল।
সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ইছা। আর রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মাহদীন চৌধুরী।
মাহদীন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “সামিরা তানজীনের সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর ডিএনএ মিলেছে। তার মানে হচ্ছে, মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা ব্যক্তিই হারিছ চৌধুরী। তার দেহাবশেষ এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ সম্মান দিয়ে তাকে তার পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।”
বাবার পরিচয় প্রকাশে রিট আবেদনের পর গত সেপ্টেম্বরে সামিরা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “এখানে যাকে প্রফেসর মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা হয়েছিল, তিনিই হারিছ চৌধুরী।
“বিগত স্বৈরাচার সরকার তাকে গ্রামে নিয়ে দাফন করতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে করোনাভাইরাসের সময় সাভারের এই মাদ্রাসায় বাবাকে কবর দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বাবার মৃত্যু সনদ চেয়ে আবেদন করা হলেও স্বৈরাচার সরকার আমাদের কথা শোনেনি।”
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে থাকা হারিছ চৌধুরী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন।
নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হারিছ যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের পদেও ছিলেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে হারিছ ধানের শীষের প্রার্থী হয়ে হারলেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে করেন নিজের বিশেষ সহকারী। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর করেন রাজনৈতিক সচিব।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর লাপাত্তা হয়ে যান হারিছ। তার বাড়ি সিলেটে হলেও পরিবার থাকত যুক্তরাজ্যে। ফলে ধারণা করা হয়েছিল, তিনিও সেখানে চলে গেছেন। তবে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি কখনও।
এরমধ্যে দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় পলাতক হারিছে চৌধুরীর সাজা হয়। প্রথমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি গাড়ি অন্যকে ব্যবহার করতে দেওয়ায় আরেক মামলায় তার ৫৯ বছরের কারাদণ্ডাদেশও হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবসানের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েও হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলতে থাকে। ২০১৮ সালে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে হারিছেরও সাত বছরের সাজা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলারও আসামি ছিলেন হারিছ।
২০১৮ সালে গ্রেনেড হামলার মামলায় হারিছের সাজার রায় হয়। সেই রায়ে আপিলের আবেদনে গত রবিবার সব আসামিকে খালাস দেয় হাই কোর্ট।
কিছু দিন আগেও ইন্টারপোলের রেড নোটিসে হারিছ চৌধুরীর নাম দেখা যাচ্ছিল। তবে বুধবার আদালতের আদেশের পর ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে হারিছের ছবিসহ নামটি দেখা যায়নি।
মৃত্যুর খবর, সংশয়
২০২২ সালের ৬ মার্চ মানবজমিনের প্রতিবেদনে তার পরিবারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, হারিছ চৌধুরী ৬৮ বছর বয়সে আগের বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। পরদিন ঢাকার অদূরে সাভারে একটি মাদ্রাসায় মাহমুদুর রহমান নামে তাকে দাফন করা হয়।
হারিছ ১১ বছর ধরে মাহমুদুর নামে ঢাকার পান্থপথের একটি ফ্ল্যাটে থাকছিলেন বলেও দাবি করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
তাতে বলা হয়েছিল, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (ওয়ান ইলেভেন) জরুরি অবস্থা জারির পর আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। এই ১৪ বছরের ১১ বছরই তিনি ছিলেন ঢাকার পান্থপথে। এসময় বেশভূষার পাশাপাশি নামও বদলে ফেলেন তিনি। মাহমুদুর রহমান নামে একটি পাসপোর্টও করিয়ে নেন। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এই পাসপোর্ট ইস্যু হয়।
মানবজমিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন হারিছ। মারা যান ৩ সেপ্টেম্বর। তার লাশ গ্রহণ করেন মেয়ে সামিরা চৌধুরী।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তখন তাদের নাকের ডগায় ফেরারী আসামি হারিছের থাকা এবং মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। কারণ এর আগে থেকে তারা বলে আসছিলেন, হারিছ বিদেশে পালিয়ে আছেন।
মাহমুদুর রহমান নামে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে দেওয়া একটি মৃত্যু সনদও মানবজমিন প্রকাশ করেছিল।
সেই সনদ ধরে তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে সেই সনদে রোগীর অভিভাবক হিসাবে যে ‘আব্দুল হাফিজ’ নামে ব্যক্তির নাম রয়েছে, তার ঠিকানায় সেই নামের কেউ নেই।
তবে ঢাকার উত্তরার ওই ঠিকানায় ফ্ল্যাটের মালিকের নাম মাহমুদুর রহমান এবং তিনি জীবিত আছেন।
তবে ওই মাহমুদুর রহমানের স্ত্রী জানান, তিনি বা তার স্বামী হারিছ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেনই না। মৃত্যুসনদে ঠিকানার মিলে তারাও বিব্রত।
ওই মাহমুদুর রহমান একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর বাবার পরিচয় শনাক্তে সামিরা তানজিম হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। তখন আদালত লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দেয়।
ওই আবেদনে সামিরা তার বাবা হারিছ চৌধুরীকে কমলাপুর জালালাবাদ এলাকায় অবস্থিত জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদ্রাসার কবরস্থানে মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করা হয়েছে বলে জানান।
এখন দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পরিচয় প্রমাণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা, মৃত্যু সনদ, ইন্টারপোলের রেড নোটিস থেকে নাম মুছে ফেলা এবং নিজ জেলায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফনের আরজি জানান তিনি।
এরপর আদালতের নির্দেশে লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিআইডিকে নমুনা পাঠায় স্থানীয় প্রশাসন। পরীক্ষার প্রতিবেদন হাই কোর্টে জমা হওয়ার পর হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে সব সংশয় এবার কাটল।