যে কোনও ব্র্যান্ডের তরল দুধের প্যাকেট এনে সরাসরি গ্লাসে ঢেলে পান করতে চান না এমন অনেকেই আছেন। ছোটদের কেউ যদি এমন করতে যায়, তাহলে তাদের থামিয়ে চুলায় দুধ গরম করে তারপর উষ্ণ দুধের গ্লাস হাতে তুলে দেবেন বাড়ির মুরুব্বীরা।
বিশেষ করে বয়স্করা মানেন যে, প্যাকেট খুলে তরল দুধ সরাসরি পান করলে তা শরীরের জন্য ভালো নয়।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের মতামত হচ্ছে, পাস্তুরিত লেখা প্যাকেটের তরল দুধ কিনে এনে গরম করা ঠিক নয়। এতে তরল দুধের পুষ্টি কমে যায়।
দুই বিপরীত মত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন তাই জানার চেষ্টা করেছে ইন্ডিয়া টুডে।
নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হসপিটালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক রাকেশ গুপ্তা; তিনি ইন্ডিয়া টুডেকে বলেন, “দুধ গরম করে পান করা ভারতের যুগ যুগের অভ্যাস।
“আগে তো দুধ দিয়ে যেতো গোয়ালা। এই দুধে থাকা ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য মাইক্রোঅর্গানিজম যেন শরীরে অসুখ না বাধাতে পারে তাই চুলায় গরম করে বা ফুটিয়ে নেয়া জরুরি ছিল।”
ভারতের আবহাওয়া ও গ্রামে সবার ফ্রিজ না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন এই চিকিৎসক।
আর এ কারণে আজকাল তরল দুধ প্যাকেটজাত হয়ে বাজারে পাওয়া গেলেও ‘স্বাস্থ্যের ভালো থাকার কথা ভেবে দুধ ফুটিয়ে নেন তারা’।
পুনে শহরে মনিপাল হসপিটালের ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের পরামর্শক চিকিৎসক বিচার নিগম জানালেন দুধ ফুটিয়ে নিলে কী হয়।
“১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল দুধ ফুটতে থাকে। তখন গোয়ালের দুধে থাকা সালমোনেলা বা ক্লোস্ট্রিডিয়াম অণুজীবগুলো আর টিকে থাকতে পারে না।”
গরম করার সময় তরল দুধে অনেক পরিবর্তন ঘটে বলে জানালেন গুপ্তা।
গরম হতে হতে দুধের ব্যাকটেরিয়া ও অন্যসব অণুজীব মারা যায়। এতে করে দুধ পান করা স্বাস্থ্যের জন্য আর ক্ষতিকারক থাকে না।
গরম করা হলে দুধের প্রোটিনের গঠনে কিছু বদল আসে; যা বিপাক সহায়ক ওঠে। দুধে থাকা চর্বিও ভেঙে গিয়ে শরীরে পুষ্টি শোষণ সহজ করে তোলে।
দুধ চুলাতে ফুটিয়ে নিলে ল্যাকটোজ আরেকটু গাঢ় হয়ে মিষ্টতা আনে। এতে তরল দুধও আরেকটু ঘন হয়; যা বেশ মোলায়েম লাগে খেতে।
তাছাড়া দুধ ফুটিয়ে নিলে নষ্ট হওয়ার ভয়ও কেটে যায়।
তাহলে প্যাকেটের দুধ কি ফুটিয়ে নিতে হবে?
যদি পাস্তুরিত দুধ না হয়, তাহলে অবশ্যই ফুটিয়ে নিতে হবে বলে জানালেন চিকিৎসক নিগম।
কারণ অপাস্তুরিত বা কাঁচা দুধে অণুজীব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
গুরুগ্রামের ডায়েটিশিয়ান অর্চনা মনে করেন, “ভারতে সিলগালা করা প্যাকেটে যে দুধ পাওয়া যায় তা সাধারণত পাস্তুরিত।
“অর্থাৎ প্যাকেট করার আগে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে ওই তরল দুধ গরম করে নেয়া হয়েছে। তাই একদিক থেকে প্যাকেটের কেনা দুধ গরম করে খাওয়া জরুরি নয়।”
এমনিতে যারা প্যাকেটজাত তরল দুধ কিনে এনে ফুটিয়ে নেন, তারা শুধুই যে স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেন তা নয়। আসলে তারা দুধ ফুটিয়ে খেতে হয় এ কথা শুনে এসেছেন বংশ পরম্পরায়।
আর চুলায় জ্বাল দেয়া দুধের ঘনত্ব ও স্বাদেও পরিবর্তন আসে; অনেকের কাছে এই স্বাদ ভালো লাগে।
অন্যদিকে যদি কোনো ভাবে প্যাকেট ঠিক মতো দোকানে রাখা না থাকে সে কারণে সাবধানতার হিসেবেও দুধ ফুটিয়ে নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন চিকিৎসক গুপ্তা।
উদয়পুরের ডায়েটিশিয়ান রিধিমা খামেসরা অবশ্য সতর্ক করে বলছেন, দুধ ফুটানো হলে যেমন খারাপ ব্যাকটেরিয়া মারা যায়, তেমন কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস হয়।
তরল দুধ ফুটানোর সময় ভিটামিন সি ও বি কিছুটা হলেও নষ্ট হয়।
“পান করার আগে দুধ সামান্য ফুটিয়ে নেয়া যেতেই পারে। মাঝারি আঁচে এক গ্লাস দুধ চার কি পাঁচ মিনিটেই গরম হয়ে যায়।”
এভাবে গরম করা দুধের স্বাদও ঠিক থাকে আবার পুষ্টিগুণও বজায় থাকে।
পাস্তুরায়নে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দুধ ফুটানো হয় যেন পুষ্টিগুণ ঠিক থাকে কিন্তু ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়।
দুই ভাবে দুধ পাস্তুরিত করা হয় – হাই টেমপারেচার শর্ট টাইম (এইচটিএসটি) এবং আলট্রা-হাই টেমপারেচার (ইউএইচটি)।
উচ্চ তাপে ও অল্প সময়ে পাস্তুরায়নে (এইচটিএসটি) ৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১৬১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় কাঁচা দুধকে ১৫-২০ সেকেন্ডের জন্য রাখা হয়।
অন্যদিকে অতি উচ্চ তাপমাত্রা মানে ১৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ২-৫ সেকেন্ড দুধ গরম করা হয় ইউএইচটি প্রক্রিয়ায়। এ ধরনের প্যাকেটের মুখ খোলা না হলে এ ধরনের তরল দুধ ফ্রিজে না রেখেও অনেকদিন ভালো থাকে।
সাধারণত প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে পাস্তুরিত না কি অপাস্তুরিত দুধ।
পাস্তুরিত দুধ এনে গরম করে নিলে তাতে বাড়তি কোনো লাভ হয় না বলে জানালেন চিকিৎসক নিগম।
তবে প্যাকেটের গায়ে ময়লা দেখা গেলে অথবা পুরো প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে হয়েছে কি না তা নিয়ে মনে সন্দেহ জাগলে দুধ ফুটিয়ে নেয়া যায়।
খেয়াল রাখতে হবে, গ্রাহকের কেনার জন্য দোকানে সরবরাহ করা পাস্তুরিত দুধের প্যাকেট সব সময় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এই চালানে তাপমাত্রা ধরে রাখতে বড় কোনো গাফেলতি হলে দুধের মান নষ্ট হতে পারে।
গাভী, মহিষ এবং পূর্ণ ননিযুক্ত তরল দুধ সাধারণ ভাবেই চুলায় ফুটিয়ে নেয়া যায়।
স্কিমড বা চর্বিহীন দুধ এবং কম-চর্বিযুক্ত দুধ হলে নরম আঁচে গরম করতে হবে যেন প্রোটিন নষ্ট না হয়।
কাঠবাদাম, সয়া এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ দুধ হলে গরম করে খাওয়ার দরকার নেই। গরম করলে বরং পুষ্টি ও সুগন্ধ কমে যাবে।
ল্যাকটোজ ছাড়া দুধ হলে ভালো ভাবে গরম করে নিতে হবে। গুঁড়ো দুধ হলে প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা মেনে গরম করা যেতে পারে।