“আমার কখনই ঘুমের সমস্যা ছিল না। কিন্তু গত ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে ঘুমাতে পারছি না। মুভি দেখছি, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি, রান্না করছি, বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি- কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না,” বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইইসিইউ) কাজ করে যাওয়া একজন চিকিৎসক।
নিজেকে মানসিকভাবে শক্তই মনে করেন এই নারী চিকিৎসক। তবে কিন্তু মধ্য জুলাইয়ের পর নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণাই বদলে গেছে।
তার ভাষায়, সাধারণত মানসিকভাবে শক্ত যারা আইসিইউতে তারাই কাজ করেন। এভাবেও বলা যায়, কাজ করতে করতে তারা মানসিকভাবে শক্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এখন তারাও ‘ট্রমাটাইজড’।
এই ট্রমা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক হতাহতের কারণে। দুই শতাধিক মৃত্যুই শুধু নয়, হাজার হাজার আহত সামলাতে হচ্ছে চিকিৎসকদের, যাদের বেশিরভাগ আবার গুলিবিদ্ধ।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে জুলাই মাসের শুরুতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামলেও তা সংঘাতে গড়ায় ১৫ জুলাই। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হওয়ার পর হাসপাতালে ভিড় বাড়তে থাকে।
পরদিন ১৬ জৃুলাই সহিংসতায় ঢাকায় দুজনসহ চট্টগ্রাম ও রংপুরে ৬ জন নিহত হয়। একদিন বাদে ১৮ জুলাই সহিংসতা গ্রাস করে গোটা দেশকে। কয়েকদিনেই নিহতের সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়ে যায়। এই গুলি চালানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনে বাধ্য হয়। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় কোটা সংস্কার হলেও শিক্ষার্থীরা হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে এখনও কর্মসূচিতে রয়েছে, সংঘাতে হতাহতও থেমে নেই।
গত ২৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে ৯৯টি লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছিল, তাদের সবাই ছিল গুলিবিদ্ধ।
ঢাকা মেডিকেল থেকে সেদিন জানানো হয়েছিল, ১৫ জুলাই থেকে তখন পর্যন্ত সহিংসতায় আহত ১ হাজার ৬৯ জন এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। তাদের মধ্যে ১৫৯ জন তখনও ভর্তি। তাদের অনেকের অবস্থা গুরুতর।
ঢাকা মেডিকেলের সেই চিকিৎসক বলেন, “চোখের সামনে এত রক্ত, এত বাঁচার আকুলতা, এত মৃত্যু, স্বজনদের আহাজারি, টেলিভিশনে-ফেইসবুকে এত গ্রেপ্তারে খবর, শিক্ষার্থীদের এভাবে পেটানোর দৃশ্য! আমরা সবাই ট্রমাটাইজড।”
নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি এই চিকিৎসক; কারণ হিসাবে বললেন, “আমাদের কিন্তু বদলি করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে।”
শুরুতে ঢাকা মেডিকেল থেকে হতাহতের তথ্য সাংবাদিকদের দেওয়া হলেও পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি ঢাকা মেডিকেলে ঢুকতেও বাধা পাচ্ছেন সাংবাদিকরা। ঢুকতে গিয়ে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও আছে।
কেমন ছিল ১৫ জুলাইয়ের পরিস্থিতি- তা তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, “সাধারণত হাসপাতালের নিচতলায় ওসেক (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) এ এক থেকে দুজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের (অবেদনবিদ) ডিউটি থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সেখানে আরও দুজনকে আনা হয়। বলা হয়, প্রেসার অনেক বাড়বে, দুজন সামলাতে পারবে না। আসলে পরিস্থিতির কিছুটা সেদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল।
“এরপর রাতও বাড়তে থাকে, রোগীও বাড়তে থাকে। চারপাশ থেকে রোগী আসছে। ক্যাজুয়ালটি আর নিউরোসার্জারির চিকিৎসকরা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। রোগীদের অবস্থা দেখে আর্তনাদ করছেন। রাত হয়ে যাওয়াতে অনেক চিকিৎসকই হাসপাতাল ছেড়েছিলেন, কিন্তু হাসপাতালের আশেপাশে যারা থাকেন, তারা সবাই সেদিন চলে এলেন।”
এরপর লাশ দেখতে দেখতে সহকর্মীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন বলে জানান এই চিকিৎসক।
“আপনি রোড ট্রাফিকের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন, অসুখ হয়ে মৃত্যু হয়েছে, এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। কিন্তু এভাবে গানশট ইনজুরি! এভাবে এই বাচ্চাগুলো…”
আইসিইউর পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “একজনের ছিল গানশট ইনজুরি ছিল পেটে। তার এত রক্তক্ষরণ হয়েছে, ছয় দিন পর্যন্ত তার ইউরিন আউটপুট বন্ধ ছিল। কিডনিটা শাটডাউন করলো, আর কাজ করলো না, চলে গেল সে চোখের সামনে।”
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তার দায়িত্ব ছিল আইসিইউতে। আগের দিন গুলিবিদ্ধ ১৭ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু হয় সেদিন।
“তার এমআরআইতে এল বুলেট শট ইনজুরি …মাথাটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তার অবস্থা দেখেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, যতই তরুণ হোক, যতই তাগড়া শরীর থাকুক, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, সবাই মিলে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফেরাতে পারিনি।”
এই চিকিৎসক জানান, বৃহস্পতি থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ২০ জনকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। বর্তমানে রয়েছে সাত/আটজন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো।
একজন রোগীর বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এই তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। তারও গলব্লাডার, লিভার ফুটো হয়ে গেছে। বয়স কম বলে হয়ত বেঁচে উঠবে। এই হচ্ছে মন্দের ভালো।”
আহতদের বিবরণ দিতে দিতে একাধিকবার এই চিকিৎসকের গলা ধরে এসেছে, চুপ থেকেছেন, কেঁদেও ফেলেছেন; নিজেকে সামলে পরক্ষণেই বলেছেন, “আমার তো ইচ্ছে করছে, বাচ্চাগুলোর (শিক্ষার্থী) পাশে গিয়ে দাঁড়াই।”
“কাঁদতে চাই নাই, কিন্তু নিস্ফল আক্রোশে কেঁদে ফেলেছি,” বলেই আবার কেঁদে ফেলেন এই চিকিৎসক; খানিকটা সামলে নিয়ে বলেন, “আইসিইউতে কাজ করা চিকিৎসকদের লেখাপড়া করতে হয়, কিন্ত কেউ সেটা করতে পারছি না। এই ট্রমা থেকে আমরা কবে বের হতে পারব বা আদৌ পারব কি না, সেটাও জানি না।”