নির্মিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার নির্ভর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘এই পুরাতন আখরগুলি’ ।
লেখকের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্রটি। এটি নির্মাণ করেছেন ‘সুতপার ঠিকানা’খ্যাত নির্মাতা প্রসূন রহমান। ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর মারা যান হাসান আজিজুল হক।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের শিরোনামটি লেখকের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ থেকেই নেয়া।
“মানুষের ভাবনা-জগৎ খুঁড়ে দেখবার আনুষ্ঠানিক নাম সাক্ষাৎকার। সৃজনশীল সাক্ষাৎকার খুলে দিতে পারে কৃতি মানুষদের অন্তঃপুরের দরজা। তেমন সাক্ষাৎকার হতে পারে ইতিহাসের মূল্যবান দলিল, কিংবা সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান গবেষণার উপাত্ত। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকার হওয়া চাই গভীর অনুসন্ধানী। নেহাত কৌতুহলহীন, খেলো, নিস্পৃহ প্রশ্ন-উত্তর পর্ব মাত্র নয়। যথার্থ সাক্ষাৎকার একটি যৌথ বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযান।”
লেখক শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার সংকলন ‘কথা পরম্পরা’ গ্রন্থের ভৃমিকায় লেখা এই কথাগুলো একান্ত ভাবেই বিশ্বাস করেন নির্মাতা প্রসূন রহমান।
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতেও তেমনটাই ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন তিনি।
তিনি জানান, রাজশাহীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসন প্রকল্প ‘বিহাস’ এ নির্মিত লেখকের নিজের বাড়ি ‘উজান’ এর ভেতরেই চিত্রায়িত হয়েছে এর বেশিরভাগ অংশ। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বয়সজনিত শারীরিক অসুবিধার কারণে বাইরে খুব একটা যাওয়ার সুযোগ হয়নি।
ছবিতে হাসান আজিজুল হক নিজের উচ্চারণে তার ছেলেবেলা, দেশান্তরী হওয়া, ব্যক্তিজীবন, লেখক জীবন, তার দর্শন চিন্তা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সহ কথা বলেছেন নানা বিষয়ে। আবৃত্তি করেছেন মেঘনাদবধ থেকে, মেঘ দূত থেকে, গান গেয়েছেন গীতবিতান থেকে-
‘গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা,
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা…’
প্রসূন রহমান বলেন, “আনন্দের বিষয় স্যার বেঁচে থাকতে, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে রাজশাহীর ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র উৎসবে এর একটিমাত্র প্রদর্শনী করা সম্ভব হয়েছিল। এরপর দেশে-বিদেশে আরো কয়েকটি উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। আমাদের এখানে ৪০টির বেশি টিভি চ্যানেল থাকলেও কেউ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনে আগ্রহী নয়। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গুলোতেও প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্যে কোনো জায়গা নেই। তাই সবার জন্যে অনলাইনেই অবমুক্ত করা। আগ্রহী দর্শক ছবিটি দেখে নিতে পারেন ইমেশন ক্রিয়েটর (Imation Creator) এর ইউটিউব চ্যানেলে।”
তবে, শুধু হাসান আজিজুল হককে নিয়েই নয়, এর আগে তিনি নির্মাণ করেছেন বরেণ্য নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তানভীর মোকাম্মেলকে নিয়েও।
নির্মাতা বলেন, “নেহায়েত কৌতুহল হিসেবে নয়, মহত্তর জীবনকে তার দিনযাপনের সময়, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, দর্শন ও সৃজনশীল অভিব্যক্তিসহ চতুর্মাত্রিক মাধ্যমে ধরে রাখবার প্রয়াসে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদকে নিয়ে ২০১০ সালে প্রথম নির্মিত হয়েছিল- প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ফেরা’। দিনব্যাপী এক ভ্রমণকালে নেয়া সে সাক্ষাৎকারটির চিত্রধারণ হয়েছিল পরবর্তীতে দুর্ঘটনায় পড়া সেই মাইক্রোবাসটিতে চড়েই।”
‘ফেরা’ দেখে যাওয়া সম্ভব হয়নি তারেক মাসুদের। কেননা এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১২ সালে।
পরবর্তীতে নির্মিত হয় তানভীর মোকাম্মেলকে নিয়ে ‘নদী ও নির্মাতা’। ‘ফেরা’র মতো একই বৈশিষ্ট্য ও পরিকল্পনা অনুসরণে এটিও একদিনের ভ্রমণ।
“ধলেশ্বরী নদীতে থাকা তানভীর ভাই এর নিজস্ব দ্বিতল নৌযান নিয়ে ইছামতীর বুকে যাত্রা এবং জীবন ও চলচ্চিত্র বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কথামালা। নদী প্রিয় এবং নদী নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তানভীর ভাই। সে কারণেই বোধহয় শিরোনাম হিসেবে ‘নদী ও নির্মাতা’ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি’, বলেন নির্মাতা প্রসূন রহমান।
নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ইমোশন ক্রিয়েটর’ থেকে এ পর্যন্ত নির্মাণ করেছেন ৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনী চলচ্চিত্র, ২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ৪টি মুক্ত দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ১টি ওয়েব ফিল্ম ও ১টি ৭ পর্বের প্রামাণ্য সিরিজ। উপন্যাস, কাব্যগল্প ও প্রবন্ধ সংকলনসহ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭টি। লেখালেখি ও নির্মাণের পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন ইউল্যাব এর মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে।