Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

মার্কিন ডলার কি আস্থার সঙ্কটে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
[publishpress_authors_box]

গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক আর্থিক বাজার টালমাটাল হওয়ার পর তার প্রভাব পড়ে মার্কিন ডলারের ওপরও।

যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারগুলো ধস ঠেকাতে পারলেও ডলারের নিম্নমুখী প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না।

এর কারণ হল ট্রাম্পের কঠোর বাণিজ্য নীতি। যা এই বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে, কমিয়ে দিচ্ছে ডলারের চাহিদা।

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হিড়িক বিনিয়োগকারীদের ডলারের আধিপত্য হ্রাস বা এমনকি ফুরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।

জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের বিশ্লেষকরা সম্প্রতি গ্রাহকদের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেছে, “লিবারেশন ডে’-র (ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ ‍শুরুর দিন) প্রভাব অব্যাহত থাকায় ডলারের আস্থা সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে।”

প্রায় এক শতাব্দী ধরে ডলার বিশ্বে বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বিবেচিত। কয়েক ডজন দেশ এখনও ডলারের সঙ্গে তাদের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে, যার অর্থ তাদের মুদ্রার দাম ডলারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

তবে বিনিয়োগকারীরা এখন ডলারের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ভরসা করা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করেছেন এবং এর পরিণতি হতে পারে নাটকীয়।

ডলারের কী হয়েছে

ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বিশ্বের কয়েক ডজন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, যা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির ওপর আস্থা কমিয়ে আনে এবং মার্কিন আর্থিক সম্পদের মূল্যমানের অবনমন ঘটায়।

‘লিবারেশন ডে’র পরের তিন দিনে পুঁজিবাজারে সম্পদমূল্য থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়ে যায়।

মার্কিন ট্রেজারি, যা দীর্ঘকাল ধরে আদর্শ নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত, সেখানেও ব্যাপক বিক্রির চাপ তৈরি হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণের মূল্যমান ব্যাপক বেড়ে যায়।

সমালোচনার মুখে ট্রাম্প ৯ এপ্রিল চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন। তবে বিনিয়োগকারীরা ডলার-সম্পর্কিত সম্পদ ধারণে এখনও সতর্ক।

এপ্রিল মাসে এ পর্যন্ত অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ডলারে দর ৩ শতাংশ কমে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।

ব্যাংক জে সাফ্রা সারাসিনের প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্স্টেন জুনিয়াস আল জাজিরাকে বলেন, “বিনিয়োগকারীরা এখন মার্কিন সম্পদ বিক্রি করছে এবং ডলারের দাম পড়ছে।”

তিনি আরও বলেন, ৯ এপ্রিল থেকে মার্কিন শেয়ারের দাম যতটা বেড়েছে ডলারের দর ততটা বাড়েনি। কারণ মার্কিন অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে।

ডলার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

গত ৮০ বছর ধরে মার্কিন ডলার বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে প্রধান রিজার্ভ মুদ্রার মর্যাদা নিয়ে আছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ডলার বৈশ্বিক মুদ্রা হিসাবে আবির্ভূত হয়। ইউরোপ ও জাপান তখন সঙ্কটে পড়েছিল, আর যুক্তরাষ্ট্র অর্থ কামিয়ে নিচ্ছিল।

তারপর ১৯৭১ সালে যখন রিচার্ড নিক্সন মার্কিন ডলারের মূল্য থেকে স্বর্ণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন, তখন বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় ডলারের আধিপত্য আরও বাড়ে।

‘নিক্সন শক’র পর বেশিরভাগ দেশ স্বর্ণের রূপান্তরযোগ্যতা ত্যাগ করে তাদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে বেঁধেছিল।

ডলার তখন আদর্শ মুদ্রা হয়ে ওঠে। গত শতকের ৮০ এর দশকে উপসাগরীয় অনেক দেশ তাদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে বাঁধতে শুরু করে।

এর প্রভাব এখানেই থেমে থাকেনি। আটলান্টিক কাউন্সিলের মতে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র এক-চতুর্থাংশের অংশীদার, তবুও ২০২৩ সালে বিশ্বের ৫৪ শতাংশ রপ্তানির লেনদেন হয়েছিল ডলারে।

অার্থিক খাতে এর আধিপত্য আরও বেশি। সমস্ত ব্যাংক আমানতের প্রায় ৬০ শতাংশ ডলারে এবং প্রায় ৭০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বন্ড মার্কিন মুদ্রায়।

এদিকে আইএমএফের মতে, বিশ্বের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৫৭ শতাংশ, যা বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ধারণ করে, তা ডলারে রাখা হয়।

ফলে ডলারের রিজার্ভের মর্যাদা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, তার আর্থিক বাজার এবং তার আইনি ব্যবস্থার উপর আস্থার উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প সেখানেই নাড়া দিয়েছেন।

কার্স্টেন জুনিয়াস বলেছেন, “তিনি আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। আর বিনিয়োগকারীরা বুঝতে শুরু করছেন যে তারা মার্কিন সম্পদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।”

অ্যাপোলো অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশিরা ১৯ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন শেয়ার, ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন ট্রেজারি এবং ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন কর্পোরেট বন্ডের মালিক। এটি বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ।

যদি এই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু তাদের ডলারের অংশ কমাতে শুরু করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের মূদ্রা দীর্ঘস্থায়ী চাপের মধ্যে পড়তে পারে।

ডলারের দরপতনের পরিণতি কী

ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেকেই এই যুক্তি দেন যে ডলারের উচ্চ ‍মূল্য যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির খরচ বাড়িয়ে তুলেছে।

ট্রাম্পের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান স্টিফেন মিরান সম্প্রতি বলেছেন, ডলারের অতিমূল্যায়ন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো এবং শ্রমিকদের ওপর অযাচিত বোঝা চাপায়। ফলে তাদের পণ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার সক্ষমতা হারায়।

তিনি আরও বলেন, “ডলারের অতিমূল্যায়ন বহু বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর একটি কারণ ছিল এবং এই শুল্ক সেই অপ্রীতিকর বাস্তবতারই প্রতিক্রিয়া।”

সাধারণ অর্থে ডলারের দর পতন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সস্তা করে তুলবে, যা দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহ জোগাবে এবং দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে।

তবে এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ার দিকে আলোকপাত করে কলম্বিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী হোসে আন্তোনিও ওকাম্পো আল জাজিরাকে বলেন, “এটি আমদানিকেও আরও ব্যয়বহুল করে তুলবে, যা ভোক্তাদের ক্ষতি করবে। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।”

বিশ্ব সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্কিন ট্রেজারির পরিবর্তে সোনা ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ছে।”

ওকাম্পো আরও বলেন যে তিনি মনে করেন ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার ফলে ডলারের ওপর আস্থা কমেছে এবং অন্য নিরাপদ মুদ্রায় সবার আগ্রহ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করেছে।

গত ১১ এপ্রিল ইউরোর দর তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। মাসের শুরু থেকে সে পর্যন্ত ইউরোর দর ৫ শতাংশের মতো বাড়ে।

ডলারের বিকল্প কি আছে

সঙ্কটে পড়লেও বৈশ্বিক মুদ্রা হিসাবে ডলারের স্থান হারানোর ঝুঁকি এখনই দেখছেন না ওকাম্পো।

তিনি বলেন, “আপাতত, আমি মনে করি ডলার প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রা হিসাবেই থাকবে।”

তবে ট্রাম্পের নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হলে বৈশ্বিক ডলারের আধিপত্যও খর্ব হবে।

সেক্ষেত্রে ওকাম্পো দুটি মুদ্রার কথা বলেছেন যেগুলো লাভবান হতে পারে।

তিনি বলেন, “আমরা সম্প্রতি সুইস ফ্রাঁতে অর্থপ্রবাহ দেখেছি। তবে ইউরো হল ডলারের আসল বিকল্প।”

ইউরো বর্তমানে আন্তর্জাতিক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ডলার এখন তার তিন গুণ।

ওকাম্পো বলেন, “যদি ইইউ ঘনিষ্ঠ আর্থিক ইউনিয়ন এবং বিশেষভাবে তার আর্থিক বাজারগুলোর আরও একত্রীকরণে সম্মত হতে পারে, তবে এটি সেই মুদ্রা হবে যা আধিপত্যের মুকুট পরতে পারে।”

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত