Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

চীনের ওষুধে বিপন্ন আফ্রিকার গাধা

চীনের একটি ওষুধ তৈরিতে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫৯ লাখ গাধা জবাই করা হয়। ছবি: দ্য ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারি
চীনের একটি ওষুধ তৈরিতে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫৯ লাখ গাধা জবাই করা হয়। ছবি: দ্য ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারি
[publishpress_authors_box]

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির উপকণ্ঠে বাস করেন স্টিভ। ২৪ বছর বয়সী স্টিভ পড়তে চান চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে। তবে মেডিকেল কলেজে পড়তে গেলে যে অর্থের প্রয়োজন, তা তার নেই। এ কারণে ব্যবসায় নেমেছেন। পানি বিক্রি করে যা পান, তা দিয়ে নিজের খরচ মেটান, পাশাপাশি মেডিকেলে পড়ার জন্য অর্থ জমান।

ক্রেতাদের কাছে পানি বিক্রির জন্য নিজের গাধার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল স্টিভ। গাধা টানা গাড়িতে করে তিনি পানি সরবরাহ করেন। প্রতিদিন ২০টির মতো পানিবোঝাই জেরি ক্যান বয়ে বেড়ায় তার গাধাগুলো।

তবে প্রতিদিনের মতো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়ে দেখেন, মাঠ শূন্য। একটি গাধাও নেই। দিন-রাত হন্যে হয়ে গাধাগুলো খুঁজে বেড়ান স্টিভ। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পরের দিনও পাননি গাধাগুলো।

তিন দিন পর এক বন্ধু মারফত স্টিভ খবর পান, চুরি হয়ে গেছে তার গাধাগুলো, বেঁচেও নেই। সেগুলোকে জবাই করা হয়েছে।

স্টিভ বলেন, “আমার বন্ধু এক জায়গায় গাধাগুলোর কঙ্কাল দেখেছিল। আমি তার সঙ্গে সেখানে যাই। গিয়ে দেখি, তার কথাই ঠিক। গাধাগুলোর কঙ্কালই কেবল সেখানে পড়ে ছিল। জবাইয়ের পর চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়।”

গাধাগুলো হারিয়ে দিশেহারা স্টিভ। জীবিকার জন্য এখন কী করবেন, মেডিকেলেই বা কীভাবে পড়বেন- কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।  

শুধু কেনিয়া নয়, গাধা চুরির ঘটনা আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও দিন দিন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্টিভের মতো অনেকে ভুক্তভোগী। এ ধরনের ঘটনা থামছে না, বরং বাড়ছে।

গাধা চুরির নেপথ্যে

দেশে দেশে গাধা চুরি করে এরপর জবাই করে চামড়া আলাদা করা হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইজিয়াও নামে ঐতিহ্যবাহী এক ওষুধ তৈরি করে চীনারা। এটির একটি উপাদান গাধার চামড়ায় থাকা জেলাটিন। এটি পেতে গাধার চামড়া সিদ্ধ করা হয়। সব উপাদান এক করে তরল, পাউডার বা ওষুধের বড়ির আকারে বানানো হয় ইজিয়াও।

সাধারণত গরম পানি বা ওয়াইনে ৫ থেকে ১০ গ্রাম ইজিয়াও ঢেলে খাওয়া হয়। সঙ্গে মেশানো হয় আরও কয়েকটি উপাদান। শুধু ইজিয়াও খাওয়ারও চল আছে।  

চীনাদের বিশ্বাস, বিভিন্ন ধরনের অসুখ যেমন রক্তক্ষরণ, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা, শুষ্ক কাশি সারাতে কার্যকর এই ওষুধ। যদিও এর পক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গাধার চামড়ায় থাকা জেলাটিন দিয়ে তৈরি করা হয় ইজিয়াও। ছবি: দ্য ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারি

নানা ধরনের অসুখ সারানোর পাশাপাশি ইজিয়াও-এর মধ্যে স্বাস্থ্য বর্ধনকারী ও যৌবন রক্ষাকারী গুণাবলী আছে বলেও মনে করে চীনারা।

এসব কারণে গাধার চামড়ার ব্যাপক চাহিদা চীনে। যেহেতু আফ্রিকায় প্রচুর গাধা পাওয়া যায়, এজন্য সেখান থেকে এই চাহিদার বড় অংশ মেটানো হয়। 

এককথায় বলতে গেলে গাধার চামড়া নিয়ে বিতর্কিত বৈশ্বিক বাণিজ্যের অপরিমেয় ক্ষতির শিকার স্টিভের মতো অনেকেই।

বিরোধিতার কারণ

গাধার চামড়ার বাণিজ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। তারা এই বাণিজ্যের বিরোধিতাও করছেন। কারণ তারা মনে করেন, স্টিভের মতো মানুষরা এবং তাদের গাধাগুলো ইজিয়াও-এর একটি উপাদানের অতিরিক্ত চাহিদার শিকার।   

বিরোধীদের মধ্যে আছে ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা দ্য ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারি। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি তাদের নতুন এক প্রতিবেদনে বলেছে, চীনাদের স্থানীয় ওষুধের চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫৯ লাখ গাধা জবাই করা হয়। আর এই চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।

গাধার চামড়ার অতিরিক্ত চাহিদা ও এর উচ্চমূল্যের কারণে প্রাণিটি চুরির ঘটনা বেড়ে চলেছে।      

ইজিয়াও তৈরিতে সরবরাহের জন্য ঠিক কতগুলো গাধা এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন।         

বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গাধা আফ্রিকায় পাওয়া যায়। এই সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ। সেখানে এক এক দেশে গাধার চামড়া রপ্তানির নিয়ম এক এক রকম। কয়েকটি দেশে এটি বৈধ। অন্য দেশগুলোতে অবৈধ।

ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারি জানিয়েছে, যেসব দেশে গাধার চামড়া রপ্তানি বৈধ, আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে সেসব দেশে এই প্রাণী চালান দেওয়া হচ্ছে।                              

তবে আগামীতে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে পারে। গাধার সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গাধা জবাই ও রপ্তানি বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে আফ্রিকার প্রতিটি দেশ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলও এই দলে আছে।

নাইরোবিতে বাস করা ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারির কর্মী সলোমন ওনিয়াঙ্গো বলেন, “আমরা হিসাব করে দেখেছি, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চামড়া বাণিজ্যে সরবরাহ দিতে কেনিয়ায় প্রায় অর্ধেক গাধা জবাই করা হয়।” 

আফ্রিকার সব দেশের নেতাদের উপস্থিতিতে শনিবার ও রবিবার হতে যাচ্ছে আফ্রিকান ইউনিয়ন সামিট। মহাদেশজুড়ে গাধা রপ্তানি বন্ধে অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত প্রস্তাব সম্মেলনের এজেন্ডার মধ্যে আছে।

এ বিষয়ে স্টিভ বলেন, “আশা করি, গোটা আফ্রিকায় গাধা রপ্তানি নিষিদ্ধের আইন হলে তা প্রাণীটিকে রক্ষায় সহায়তা করবে। নয়তো পরের প্রজন্মের জন্য একটা গাধাও থাকবে না।” 

পরের প্রজন্মের জন্য কোনও গাধা থাকবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে নিষেধাজ্ঞা দিলে কি গাধার চামড়ার ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে, যেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই?

সরবরাহ থামছে না

চীনে ইজিয়াও যারা উৎপাদন করেন, তারা আগে জেলাটিন পেতে তাদের দেশের গাধা ব্যবহার করতেন। ফলে ১৯৯০ সালে যেখানে দেশটিতে ১ কোটি ১০ লাখ গাধা ছিল, ২০২১ সালে তা কমে মাত্র ২০ লাখে এসে দাঁড়ায়। এটি চীনের কৃষি ও পল্লীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য।

গাধার সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় চীনা কোম্পানিগুলো প্রাণীটির চামড়া পেতে দেশের বাইরে হাত বাড়ায়। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে করা হয় গাধার কসাইখানা।

প্রাণীটির চামড়ার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে একপর্যায়ে আফ্রিকায় শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা।        

ইজিয়াও একসময় বিলাসবহুল পণ্য ছিল, এখনও আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য পণ্য হয়ে ওঠায় এর চাহিদাও গেছে বেড়ে।

আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় গাধার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। জনবিক্ষোভ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার জেরে ২০১৭ সালে দেশটির দুটি গাধার কসাইখানার একটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তানজানিয়া, আইভরি কোস্টসহ আফ্রিকার আরও দেশ ২০২২ সালে গাধা জবাই ও চামড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করে।

এসব ঘটনা অবশ্য চীনকে তাদের গাধার চামড়ার ব্যবসা থেকে সরাতে পারেনি। বরং তারা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের শরণাপন্ন হয় এবং একপর্যায়ে পাকিস্তান এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।

গত বছর পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো দেশটির প্রথম ‘আনুষ্ঠানিক গাধা প্রজনন খামার থেকে সেরা জাতের গাধা উৎপাদিত হবে’ বলে জোর প্রচার চালায়।

গাধার চামড়া এখন বিশাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সিডনির চীন-আফ্রিকা সম্পর্কবিষয়ক অধ্যাপক লরেন জনস্টন জানান, চীনে ইজিয়াও বাজার ২০১৩ সালে ৩২০ কোটি ডলারের ছিল। ২০২০ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭৮০ কোটি ডলারে।  

গাধার চামড়া ব্যবসা সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা, পশু কল্যাণ অধিকারকর্মী, এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তকারীদেরও উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে।

গাধার চামড়া রপ্তানি সংক্রান্ত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আফ্রিকা থেকে চীনে যাওয়া গাধার চামড়ার চালানে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণীর দেহাবশেষ লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছে।

এই প্রাণীর চামড়ার ব্যবসার ওপর জাতীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা চোরাচালানকে আরও উৎসাহিত করবে বলে আশঙ্কা অনেকের। 

উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে গাধার মূল্য জীবিত অবস্থায় বেশি, না মৃত অবস্থায়- এ মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি বিভিন্ন দেশের নেতারা। 

ধনী নারীদের পৌষমাস, দরিদ্রদের সর্বনাশ

ডাঙ্কি স্যাঙ্কচুয়ারির প্রধান পশুচিকিৎসক ফেইথ বারডেন। তিনি বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে গাধা। শক্তিশালী এই পশু পরিবেশের সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। পানি না খেয়ে ২৪ ঘণ্টা খাটতে পারে। দ্রুত পানি পান করে গাধারা পানিশূন্যতা দূর করতে পারে এবং এতে তাদের কোনও ক্ষতি হয় না।” 

তবে গাধার সমস্যা হচ্ছে তারা দ্রুত ও সহজে সন্তান উৎপাদন করতে পারে না। এ কারণে অধিকারকর্মীদের উদ্বেগ, প্রাণীটি নিয়ে ব্যবসা বন্ধ না হলে তাদের সংখ্যা কমতে থাকবে। এর প্রভাব পড়বে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর।  

ইউনিভার্সিটি অব সিডনির অধ্যাপক লরেন জনস্টন বলেন, “শত শত বছর ধরে নারী, শিশুসহ দরিদ্র মানুষদের বহন করে আসছে গাধা। যিশুখ্রিষ্ট যখন মাদার মেরির পেটে ছিলেন, তখন তাদের ভার নিয়েছিল প্রাণীটি।

“নারীদের কাছ থেকে পশুটি ছিনিয়ে নেওয়া হলে ভোগান্তির শিকার হন তারা। কারণ নারীরা তখন নিজেরাই গাধায় পরিণত হন।”

প্রান্তিক নারীদের কাজেকর্মে গাধা দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা করে আসলেও তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে, গাধা থেকে পাওয়া বিলাসবহুল পণ্য ইজিয়াও-এর প্রধান ভোক্তা চীনের ধনী নারীরা। 

২০১১ সালে চীনে টেলিভিশনে একটি শো দেখানো হতো, যার নাম ছিল ‘রাজপ্রাসাদের সম্রাজ্ঞীরা’। ওই শোতে ইজিয়াও-এর এমন প্রচার চালানো হয় যে এর চাহিদা অভিজাতদের মধ্যে বেড়ে যায়।           

টেলিভিশন শো ‘রাজপ্রাসাদের সম্রাজ্ঞীরা’-এর একটি দৃশ্য।

অধ্যাপক জনস্টন বলেন, “ইজিয়াও-এর প্রচার শোটিতে বেশ কৌশলের সঙ্গে করা হয়। শোয়ের নারীরা সৌন্দর্য ধরে রাখতে এবং স্বাস্থ্যবান হতে প্রতিদিন ইজিয়াও খেতেন। এতে তাদের ত্বক উজ্জ্বল হতো। প্রজনন ক্ষমতাও বাড়তো।

“টেলিভিশনে ‘রাজপ্রাসাদের সম্রাজ্ঞীরা’ দেখার পর ইজিয়াও-এর বিক্রি বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে এটি চীনের অভিজাত নারীদের পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর গাধা কেড়ে নিয়ে আফ্রিকার দরিদ্র নারীদের জীবনকে সঙ্কটাপন্ন করেছে ইজিয়াও।”      

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত