Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি
ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

দেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয় বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন।

তবে ঠিক কবে ড. ইউনূস শপথ গ্রহণ করবেন এবং দায়িত্ব পালনে কতজন সহকর্মীকে সঙ্গে পাবেন সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। অবশ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তা প্রকাশ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাইয়ে আন্দোলনে নামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন-পীড়নের শিকার হওয়ার পর গত শনিবার সরকার পতনের এক দফা দাবি তোলে।

তার দুই দিনের মাথায় সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে চলে যান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন জানান, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। সে লক্ষ্যে মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও তানজিম উদ্দিনসহ ১৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় বঙ্গভবনে যান। তাদের মধ্যে ১১ জন সমন্বয়ক ও দুইজন লিয়াজো কমিটির সদস্য। রাত পৌনে ৮টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধানসহ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। পরে রাত ১২টা ০৬ মিনিটে ছাত্ররা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আপনারা ইতোমধ্যে সকলে অবগত হয়েছেন আমরা সমন্বয়কবৃন্দ ও আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলন ও আমাদের যে লিয়াজো কমিটি, আমাদের সম্মানিত শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন স্যার বঙ্গভবনে এসেছিলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘসময় বর্তমান পরিস্থিতি ও অন্তবর্তীকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”

আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে দাবি করে নাহিদ বলেন, “ছাত্র ও নাগরিক অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে যে সরকারের প্রস্তাব দেওয়া হবে সেই প্রস্তাবিত সরকারই চূড়ান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, সে নিশ্চয়তা আজকে আমরা বঙ্গভবন থেকে পেয়েছি।

“আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করেই খুব দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।”

মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠক হয়।

এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ড. ইউনূসের সঙ্গে আর কে কে থাকতে পারেন, সে বিষয়ে একটি প্রাথমিক তালিকা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম।

তিনি বলেন, “সেখানে নাগরিক সমাজসহ ছাত্র প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে এই তালিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে।”

দেশের সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই ছাত্রনেতা বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধান অভ্যুত্থানকারী নাগরিক ও ছাত্রদের সম্মান জানিয়েছেন। পাশাপাশি দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি চলছে, অরাজকতা এবং সহিংসতা দেখছি নানা ধরনের, তার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নাগরিকের প্রস্তাবিত সরকারই বাংলাদেশে দ্রুত সময়ে ঘোষণা করা হবে। জনগণ যাতে সেই আস্থাটি রাখে।”

তিনি বলেন, “আমাদের যে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও সম্পদ রয়েছে তা সুরক্ষা করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। আজকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা শহরে ট্র‍্যাফিকের দায়িত্ব নিয়েছেন, মন্দির পাহারা দিয়েছেন– এটাকে সবাই প্রশংসা করেছে।

“দেশে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ফিরে আসা না পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনও ধরনের নাশকতা ও লুটপাট যাতে না হয় সেজন্য ছাত্র জনতাকে পাহারা দিতে হবে। ছাত্রজনতার নতুন যে বাংলাদেশ, আমরা সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিনের জন্য হবে বা এই সরকারে কতজন থাকবে– এই প্রশ্ন নাহিদকে করা হলেও এর উত্তর দেন তার পাশে থাকা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, “আমাদের এই তালিকা এখনই চূড়ান্ত করা হবে না। অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা চলছে।”

এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্ভাব্য সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে নাহিদ বলেন, “১০ থেকে ১৫ জনের।”

তালিকা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমরা এখনই প্রকাশ করব না। এটা প্রাথমিক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই তালিকাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা পেয়ে যাবেন।”

নির্বাচনী আইনি সংস্কারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা একটা এক্সটাঅর্ডিনারি সিচুয়েশনে এই সরকার গঠন করতে যাচ্ছি। এক্সটাঅর্ডিনারি সিচুয়েশনে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এই সরকারের বৈধতা দেওয়ার সাংবিধানিক রীতি আছে। নিয়ম আছে সেটা ফলো করা হবে। সরকারের মেয়াদ এখনই ঠিক করা হয়নি।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়কদের ভূয়সী প্রশংসা করে এই অধ্যাপক বলেন, “ছাত্রদের আলোচনার যে স্পিরিট, তাদের যে আউটকাম দেখেছি এটা মুগ্ধ করার মতো। আমি নিজে বিশ্বাস করতে পারি না। এত ম্যাচিউর্ডলি তারা ডিল করতে পারছে। আমরা খুবই আনন্দিত শুধুমাত্র অভুথ্যানের নেতৃত্ব পাই নাই, রাষ্ট্র গঠনের নেতৃত্ব আমরা পেয়ে গেছি।”

তিন বাহিনীর প্রধান অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, “ছাত্রদের সম্পর্কে এত প্রশংসা করেছেন। ছাত্রদের ট্র‍্যাফিকের দায়িত্ব নেওয়া, মন্দির পাহারা দেওয়া ও সমন্বয়কদের দেখে তাদের তরুণদের প্রতি প্রত্যাশা ও শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেছে।”

ড, ইউনূস কবে দেশে ফিরবেন জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, “ওনার একটি মাইনর অপারেশন হয়েছে। উনি আগামীকালই (বুধবার) দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। আগামীকাল (বুধবার) রাত অথবা পরশুদিন (বৃহস্পতিবার) সকালে উনি দেশে এসে পৌঁছাবেন। তার মধ্যে তালিকাটা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ২৪ ঘণ্টা বা আরও কিছু বেশি সময়ে শপথ গ্রহণের বিষয়টি শেষ করে ফেলতে পারব।”

গণমাধ্যমে হামলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা সকলকে শান্তি বজায় রাখার জন্য ভূমিকা রাখতে আহবান জানাচ্ছি। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান রক্ষা করা এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়া দায়িত্ব আমাদের।”

বিভিন্ন নাশকতা ও হামলার কথা স্বীকার করে নিয়ে এই ছাত্রনেতা বলেন, “হামলা করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে হামলা করে এই আন্দোলনে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ধরনের লুটপাট-হামলা রুখে দেবেন। গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা করবেন। থানাগুলোতে প্রয়োজনে পাহারা দেবেন। আমরা বলেছি বারবার এই ফ্যাসিস্ট রেজিমের সঙ্গে গণহত্যা জড়িত ছিল, দুর্নীতি জড়িত ছিল, তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের আওতায় আনা হবে। কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। আমরা প্রতিহিংসা রক্তপাত চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই।”

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ। প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে গত ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে সোমবার দুপুরে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার রাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হলো।

ড. ইউনূস বারবার শেখ হাসিনার সরকারের রোষের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে আসছিলেন। সম্প্রতি তাকে একটি মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হয়, সেই মামলাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তার দাবি।

গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ২০১১ সালে ইউনূসকে সরানোর পর থেকে তার সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের বিরোধ চলছিল।

১৯৮৩ সালে সরকারের অংশীদারত্বে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ছিলেন ইউনূস।

দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ২০০৬ সালে ব্যাংকটির সঙ্গে ইউনূসও যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মর্যাদার এই পুরস্কারে ভূষিত।

বয়সের কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েও হেরে যান তিনি। এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বও হারাতে থাকেন এই নোবেলজয়ী।

সরকারের সঙ্গে ইউনূসের টানাপড়েনের মধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করে।

সেই মামলায় এবছরের ২ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে শ্রম আদালত ইউনূসসহ চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয়, প্রত্যেককে জরিমানা করা হয় ২৫ হাজার টাকা। তবে আপিল করার শর্তে তারা কারাগারে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পান। তবে তার বিরুদ্ধে আরও মামলাও হয়েছে।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় নেমেছিলেন ড. ইউনূস। কিন্তু পরে পিছু হটেন।

তখন কারাবন্দি শেখ হাসিনা সেই ঘটনার জেরেই তার ওপর নাখোশ হন বলে ইউনূসের ধারণা। গত এক দশকে ইউনূসকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনার নানা বক্তব্য ছিল আলোচিত।

ইউনূসও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বলে আসছিলেন, তারা দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত