শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মামলার সাজা নিয়ে বিচলিত নন বলে জানিয়েছেন গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সাজার রায় চ্যালেঞ্জ করে রবিবার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে করা আপিলের শুনানি শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা নতুন পৃথিবী গড়ব, মানুষের পৃথিবী। ফলে সাজা আমাদের কাছে খুবই ক্ষুদ্র বিষয়। এ নিয়ে আমি বা আমরা বিচলিত নই।”
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় গত ১ জানুয়ারি ড. ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত। একইসঙ্গে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তবে এক মাসের মধ্যে আপিল করার শর্তে ওইদিন তাদের জামিন দেওয়া হয়।
সাজাপ্রাপ্ত অন্য তিনজন হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। জামিনের শর্ত মেনে রবিবার ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজন।
আপিল শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় বাকি তিন জনেরও গ্রামীণ ব্যাংকে অবদান, এখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
ড. ইউনূস বলেন, “আপনারা সবসময় আমাকে নিয়ে বলেন, বাকিদের কথা বলেন না। চার জন আসামির একজন আমি। নূরজাহান বেগমের হাত ধরে জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু হয়। গ্রামীণ ব্যাংকে শুরু থেকে যা হয়েছে, তার সব ঘটনায় তিনি ছিলেন। দুঃখজনক বিষয় হলো, আজকে নূরজাহান বেগমকেও আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।”
রাতকানা রোগের সময় বাচ্চাদের ভিটামিন খাওয়ানোর প্রকল্পে নূরজাহান বেগমের ভূমিকার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
“বাংলাদেশে যখন রাতকানা রোগ প্রবল আকারে ছিল, বাচ্চাদের ভিটামিন এ দেওয়ার আমাদের প্রকল্প তিনি পরিচালনা করেন। যেদিন আমাদের বিরুদ্ধে রায় হলো, সেদিন তিনি তার ঔষধ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, আদালত থেকে তাকে জেলে যেতে হতে পারে। যিনি সারাজীবন দেশের মানুষের জন্য কাজ করলেন, আজ তাকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হলো—এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।”
মামলার আরেক আসামি মো. শাহজাহান সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, “শাহজাহান সাহেব হাঁটতে পারেন না, চলতে পারেন না। দুবার প্যারালাইজড হয়েছেন। আজকে তাকেও আদালতে আসতে হচ্ছে।”
আশরাফুল হাসানের আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার এ সেরা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তারও আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “আশরাফ সে সময় মাত্র বুয়েট পাস করেছিল। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার দরকার ছিল। তাকে আমরা নিলাম। তখন অনেক মানুষের ঘর ছিল না। পাটখড়ি দিয়ে চাল বানিয়ে থাকত। আমরা বললাম, গ্রামীণ ব্যাংকে যারা যোগ দিবে, তারা পাটখড়ির ঘরে থাকবে না।
“আমরা বাসস্থানের ব্যবস্থা করলাম, গৃহঋণ শুরু করলাম। গৃহঋণ ছিল ৭ হাজার আর ১০ হাজার টাকা। যারা ঋণ নিবে, তারা ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করবে। আমি আশরাফকে বললাম, ‘তুমি একটা ডিজাইন কর’। আশরাফ ডিজাইন করল চার খুঁটি আর টিনের চালের ঘর। এই ডিজাইন ১৯৮৯ সালে আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচারে সেরা ডিজাইন হলো।”
সেবার বাংলাদেশের আরেকটি স্থাপনা পুরস্কার পেয়েছিল উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, “সেটা হলো লুই কানের করা বাংলাদেশের সংসদ ভবনের ডিজাইন। সেই বছর লুই কান পুরস্কার পাচ্ছে, আশরাফও পুরস্কার পাচ্ছে। আজ তাকেও হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। এগুলো কষ্ট হিসেবে থেকে যাবে জীবনে।”
সরকারের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক। ড. ইউনূস ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে অব্যাহতি দেয়, তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৭১ বছর।
এ প্রসঙ্গ টেনে ড. ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক ছিল আমাদের স্বপ্ন, আমরা দারিদ্র্য ঘোঁচাতে চেয়েছিলাম। আমরা জানতাম না, ভবিষ্যতে কী হবে। গ্রামীণ ব্যাংক আমাদের স্বপ্নের বীজতলা। আমরা ধীরে ধীরে এটাকে প্রসারিত করলাম।
“২০১১ সালে আমাকে বের করে দেওয়া হলো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। আমরা যারা এর পেছনে খাটলাম, তারা একদিকে রয়ে গেল আর আমাদের স্বপ্নের বীজতলা রয়ে গেল আরেক দিকে।”
ড. ইউনূস মনে করেন, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা খাত চলছে ভুল কাঠামোয়। তাই অনেকেই চাকরির পেছনে ছুটছে, উদ্যোক্তা হচ্ছে না।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “চাকরি মানুষের জন্য না, এটা দাসত্ব। আমরা বললাম, মানুষ জন্ম থেকেই উদ্যোক্তা। শুধু ব্যাংকিং সেক্টরের ভুলের কারণে আজকে মানুষ চাকরির পেছনে ছুটছে। আমরা ভুল কাঠামো ভেঙ্গে ফেলতে চাইলাম। সেই কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করলাম। গ্রামের অল্পশিক্ষিত নারীরা অল্প টাকায় ব্যবসা শুরু করল।
“আমরা এই নারীদের সামনে নিয়ে আসলাম। আমরা ভুল অর্থনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করলাম। এই পৃথিবীতে যত বৈষম্য-দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে, তার আসল কারণ আমাদের ভুল তাত্ত্বিক ব্যবস্থা। আমরা এর বিরুদ্ধে ছুটলাম। আমরা শিক্ষাকাঠামো পাল্টে ফেলতে চেয়েছিলাম। এই কাঠামো মানুষকে পরাধীন করে রাখে।”
চাকরি করার জন্য মানুষ তৈরি না করে উদ্যোক্তা তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দেখলাম, ব্যবসায়ীদের মাথায় মুনাফা লাভের চিন্তা সবসময় থাকে। আমরা এর থেকে বের হয়ে এসে ব্যবসাকে মানুষের উপকার এবং উন্নতির জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছি। আমরা এর নাম দিলাম সামাজিক ব্যবসা।”
এ সময় শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা সরকার করেছে, না কি শ্রমিক করেছে—এই প্রশ্ন রাখেন ড. ইউনূস।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সরকার বিভিন্ন জায়গায় বলেছে, তারা মামলা করেনি, করেছে শ্রমিকরা। কিন্তু আপনারা জানেন মামলার বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে মামলাটি কে করেছে?”
২০২১ সালে গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেসময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মামলা তারা নয়, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকরা করেছেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে মামলায় যুক্ত করা হয়।
আরও পড়ুন একটি ধারা, যাতে কারাবাস এড়ালেন ড. ইউনূস
‘যতদিন বেঁচে আছি, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চাই’
ড. ইউনূস সাংবাদিকদের আরও বলেন, “আমরা তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে চাই। যেখানে কার্বন নিঃসরণ হবে না, দারিদ্র থাকবে না, বেকারত্ব থাকবে না। সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। সম্পদের মালিক হচ্ছে বড়লোকরা- এই প্রবণতা ভাঙ্গতে হবে। আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা বেশিদিন বাঁচব না। তবে যতদিন বেঁচে আছি, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে চাই। যতটুকু পারি, করে দিয়ে যেতে চাই।”
মামলা কেন হয়েছে, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা আমি বলতে পারব না। আমরা স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। এতে হয়তো অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি।
“তবে বিশ্বাস রাখি, তরুণরা আমাদের স্বপ্নে যোগ দিবে। আজকে বিশ্বের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস স্টাডিজ সেন্টার খোলা হয়েছে। রাশিয়ায় হচ্ছে। সারা বিশ্বে তরুণরা ৩ হাজারের বেশি থ্রি জিরো ক্লাব করেছে। আমরা এসব কাজ নিয়েই থাকতে চাই। আমরা একাডেমিকদের সঙ্গে কাজ করছি। কারণ একাডেমিকরাই এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তাদেরকেই এ সমস্যার জবাব দিতে হবে।”
ড. ইউনূসের বক্তব্যের পর তার আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আদালত আমাদের আপিল মঞ্জুর করেছে। স্থায়ী জামিন দেওয়া হয়েছে আপিল শুনানি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং একই সঙ্গে শ্রম আদালতের রায় স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী আপিল শুনানি হবে মার্চ মাসের ৩ তারিখে।”
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবীশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয়নি।
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন রবিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আইন বলছে যদি কেউ ৬ মাস চাকরি করে, তাহলে সে স্থায়ী শ্রমিকে পরিণত হবে। অর্জিত ছুটি যদি না পাওয়া হয়, তাহলে সেই ছুটি তার সঙ্গে যুক্ত হবে। শুধুমাত্র ৫ শতাংশ মুনাফার যে কথা বলা আছে, সেই মুনাফা যদি কেউ না পেয়ে থাকে, তার শাস্তি কি তা ২৩৬ ধারায় বলা আছে।
“আদালত নির্দিষ্ট সময় দিবে সেটি দেয়ার জন্য। না দিলে ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং নির্দিষ্ট সময়ে না দিলে প্রত্যেক দিন ৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে। একমাস পর আদালত তা আদায় করবে।
আরও পড়ুন এখনই জেলে যেতে হচ্ছে না ড. ইউনূসকে
“সুতরাং ৩০৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার কোনও বিধান নেই। ২৩৬ ধারাতেই শাস্তির বিধান রয়েছে। ৩০৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার কোনও মানে নেই। আইন অমান্য করে ড. ইউনূসকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তার সামাজিক ব্যবসা ধ্বংস করাই মূল উদ্দেশ্য।”
২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেন। বড় সব দল তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখতে বাধ্য ছিল। দল গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সমালোচনার মুখে পড়েন ইউনূস।
২০১০ সালে নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রামাণ্যচিত্রে গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া বিদেশি অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগ ওঠে ইউনূসের বিরুদ্ধে। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি আদায়ের প্রক্রিয়া নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।