রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শূন্যতা পূরণে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে শপথ নেন তিনি। তার সঙ্গে এই সরকারের আরও ১৩ জন উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন।
বঙ্গভবনে এই শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের কেউ এই অনুষ্ঠানে ছিলেন না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই শপথ অনুষ্ঠান।
শপথ অনুষ্ঠানের শুরুতেই জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে ড. ইউনূসকে নিয়োগ দিয়েছেন।
এরপর তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন। এরপর গোপনীয়তার শপথ নেন। যে গ্রামীণ চেকের ফতুয়া ও কটি পরে তিনি বিমান থেকে নেমেছিলেন, তা পরেই উপস্থিত হন বঙ্গভবনে।
এরপর উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সাবেক উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান শুভ্র, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উবিনীগের ফরিদা আক্তার, ব্রতীর শারমিন মুরশিদ, গ্রামীণ ব্যাংকের নূরজাহান বেগম, হেফাজতে ইসলামের নেতা আ ফ ম খালিদ হাসান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ।
উপদেষ্টা হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই আযম বীর প্রতীক, ডা. বিধান রঞ্জন রায়কে মনোনীত করা হলেও তারা ঢাকার বাইরে থাকায় শপথ অনুষ্ঠানে নেই বলে জানানো হয়।
ইউনূস শপথ নেওয়ার পর উঠে গিয়ে তার সঙ্গে হাত মেলান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত জুলাই মাসে, দমন-পীড়নের মুখে তা জনবিক্ষোভে পরিণত হলে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে নোবেলজয়ী ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন। প্যারিসে অবস্থানরত ইউনূস সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের অনুরোধ তারা ফেলতে পারছেন না।
শপথ নেওয়ার দিন বৃহস্পতিবার দুপুরেই দেশে ফেরেন ৮৪ বছর বয়সী ইউনূস। বিমানবন্দরে নেমে তিনি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এই অর্জনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, “তারা এদেশকে রক্ষা করেছে, পুনর্জন্ম দিয়েছে দেশকে।
“দ্বিতীয় বার স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এই স্বাধীনতা সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। এই বাংলাদেশ যেন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই।”
‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ রক্ষা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শৃঙ্খলা ফেরানোর ওপর জোর দেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “আমার প্রথম কথা হলো বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন।”
দেশবাসীর উদ্দেশে ইউনূস বলেন, “আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, নিশ্চিত করেন যে দেশের কোনও জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না।
“আমার কথা যদি না শোনেন, তাহলে আমাকে বিদায় দেন। আমার প্রথম কথা হলো, বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেন।”
যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হলো, সেই আন্দোলনে নিহত রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ইউনূস।
“আবু সাঈদের ছবি আমাদের সবার মনে গেঁথে আছে, তা কেউ ভুলতে পারবে না। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তারপর যুবক-যুবতী সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। যে তরুণ সমাজ দেশকে রক্ষা করেছে, তাদের প্রতি সমস্ত প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা।”
ইউনূসকে স্বাগত জানাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
অর্জনের কৃতিত্ব তরুণদের দিয়ে দেশ গড়ার কাজও তাদের মাধ্যমে করার কথা বলেন নতুন সরকারের সম্ভাব্য প্রধান ইউনূস।
“তারা এটা অর্জন করে নিয়ে এসেছে, তাদেরকে দিয়ে এটা করিয়ে নেওয়া। তরুণ সমাজকে বোঝাব, এই দেশ আজ তোমাদের হাতে, তোমারা যেভাবে স্বাধীন করেছ, গড়তেও পারবে”
“পুরনোদের বাদ দাও, তাদের চিন্তা দিয়ে হবে না। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, যে সৃজনশীলতা আছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে,’ বলেন তিনি।