Beta
শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ড. ইউনূস এবার অর্থ আত্মসাতে অভিযুক্ত

দুদকের মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন 
ঢাকার আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি
দুদকের মামলায় অভিযোগ গঠনের দিন ঢাকার আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দণ্ডিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় বিচারের মুখে।

বুধবার ঢাকার জজ আদালত এই মামলায় ইউনূসসহ ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ১১ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণ অর্থাৎ বিচার শুরুর দিন ঠিক করে দিয়েছে।

এই মামলায় দোষি সাব্যস্ত হলে ইউনূসের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। এর আগে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ৬ মাসের কারাদণ্ড নিয়ে শর্ত সাপেক্ষ মুক্ত আছেন তিনি।

নোবেলজয়ী ইউনূস তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। তার দাবি, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের রোষের শিকার।

অন্যদিকে তার এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদালতের ওপর সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ নেই। বরং ইউনূসই সরকারকে বিপদে ফেলতে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

এক যুগ আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে সরকারের সঙ্গে তার টানাপড়েন চলছে।

১৯৮৩ সালে সরকারের অংশীদারিত্বে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ছিলেন ইউনূস। দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ২০০৬ সালে ব্যাংকটির সঙ্গে ইউনূসও যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

বয়সের কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েও হেরে যান তিনি। এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের পাশাপাশি এর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বও হারাতে থাকেন এই নোবেলজয়ী।

সরকারের সঙ্গে ইউনূসের টানাপড়েনের মধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করে।

সেই মামলায় গত ২ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে শ্রম আদালত ইউনূসসহ চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয়, প্রত্যেককে জরিমানা করা হয় ২৫ হাজার টাকা। তবে আপিল করার শর্তে তারা কারাগারে যাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পান।

সেই মামলার রায়ে বিচারক বলেছিলেন, “মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ইউনূসের অপরাধের বিচার হয়েছে, নোবেলজয়ী হিসেবে নয়।”

গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যে ২০২৩ সালের ৩০ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ সংস্থার উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান মামলা করেন ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে।

এজাহারে ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে স্থানান্তর ও হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যানসহ অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

সেই মামলার তদন্ত করে দুদকের একই কর্মকর্তা গত ১ ফেব্রুয়ারি ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

গত ২ এপ্রিল সেই অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আসসামছ জগলুল হোসেন। এরপর তিনি বিচারের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এ পাঠিয়ে দেন মামলাটি।

বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেনের আদালতে অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়।

আসামিরা আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। আদালতে তাদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তবে ইউনূসদের সেই আবেদন নাকচ করে বিচারক অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

ইউনূস ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের অন্য যারা এই মামলায় বিচারের মুখোমুখি হচ্ছে, তারা হলেন- ড. নাজমুল ইসলাম, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম, এস এম হুজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, ইউনিয়নের প্রতিনিধি মো. মাইনুল ইসলাম ও দপ্তর সম্পাদক মো. কামরুল হাসান।

গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান শ্রম আইনের মামলায়ও ইউনূসের সঙ্গে দণ্ডিত।

বুধবার অভিযোগ গঠনের সময় ইউনূস আদালতে উপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই সরকার আমলে তিনি ‘ক্রমাগত হয়রানি’র শিকার হচ্ছেন।

ছয় মাস আগে শ্রম আদালতে রায়ের পর তিনি বলেছিলেন, “যে দোষ করিনি, সেই দোষের শাস্তি পেলাম।”

সম্প্রতি এক মামলায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে করা আপিলের শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি।

দুদকের মামলায় কী অভিযোগ, শাস্তি কী

দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান অভিযোগ করেন, আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে সেই অর্থ অবৈধভাবে স্থানান্তর করেছেন, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।

গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের ৩৪ দশমিক ০২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকে কর্তৃত্ব হারালেও গ্রামীণ টেলিকমসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ এখনও ধরে রেখেছেন ইউনূস।

দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২২ সালে ড. ইউনূস ও নাজমুল ইসলামসহ গ্রামীণ টেলিকম বোর্ড সদস্যদের সিদ্ধান্তে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। তার আগে গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনা লভ্যাংশ বিতরণের জন্য গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন এবং গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয় ওই বছরের ২৭ এপ্রিল।

গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ঢাকার মিরপুরের এই ভবনে।

ওই চুক্তিতে ৮ মে ব্যাংক হিসাবে টাকার যে অঙ্ক দেখানো হয়েছিল, তা অসম্ভব ঠেকেছে দুদকের কাছে।

এজাহারে বলা হয়, বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২২ সালের ১০ মে গ্রামীণ টেলিকমের ৪৩৭ কোটি ১ লাখ ১২ হাজার ৬২১ টাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখা থেকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থানান্তর করা হয়। পরে ২২ জুন বোর্ড সভায় অ্যাডভোকেট ফি হিসাবে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৯ টাকা প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয়।

অন্যদিকে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখার হিসাব থেকে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ডাচ বাংলা ব্যাংকের হিসাব থেকে তিন দফায় মোট ২৬ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা স্থানান্তর করা হয়। তার মধ্যে ৩ কোটি টাকা সিবিএ নেতা মো. কামরুজ্জামান, মাইনুল ইসলাম ও ফিরোজ মাহমুদ হাসানের ডাচ বাংলা ব্যাংকের মিরপুর শাখায় স্থানান্তর করা হয়।

কর্মচারীদের লভ্যাংশ বিতরণের আগেই প্রাপ্য অর্থ তাদের না জানিয়েই অসৎ উদ্দেশ্যে সিবিএ নেতাদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছিল বলে দুদকের অভিযোগ।

একইভাবে অ্যাডভোকেট ফি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ১ কোটি টাকা হস্তান্তর হলেও বাকি ২৫ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বোর্ড সদস্যদের সহায়তায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অভিযোগ।

দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলাটি করে দুদক।

মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২) ধারায় মানি লন্ডারিং করলে বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করলে কিংবা তাতে সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে দায়ী ব্যক্তির অন্যূন ৪ বছর থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে কোনও সম্পত্তি বা কোনও সম্পত্তির ওপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করলে সেই ব্যক্তির সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় এই ধারায় দোষি সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত