গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। দেশের বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান নানা সমস্যা, সংকট, জটিলতা এবং সেসব সংস্কার করে প্রত্যাশিত সমাধানের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বিশিষ্ট আইন গ্রন্থকার, প্রবন্ধকার, কলামিস্ট ও সাবেক বিচারক মঈদুল ইসলামের তিন পর্বের পর্যালোচনার তৃতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশ হলো আজ। (বি.স.)
বিচার বিভাগ সংস্কারের খসড়া রূপরেখা-২
(দ্বিতীয় পর্বের পর)
আদালতে বাধ্যতামূলক বাংলা
১৯৮৭-র ৩ মার্চের পরে শুরু হলো খাস বাংলাতে। সেদিন থেকেই জারি হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭। বাংলা ছাড়া চলবে না আর অন্য ভাষা অফিস কিংবা আদালতে। “… আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। … উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।”
সেসময়ই আইনের কারবারি আমার সিনিয়র ইংরেজি ছেড়ে বাংলা ধরলেন আইন মেনে। ইংরেজিতে ডিকটেশন দেওয়া ছিল যার এতকালের অভ্যাস তিনিই দেখি দিচ্ছেন চমৎকার বাংলায় অনায়াসে। ইংরেজি ভালো জানা বাঙালি বাংলাটা তো ভালো জানবেই। বাংলার মাটিতে জন্ম তার বাঙালির ঘরে। শুধু আমার সিনিয়র নন, রাজশাহী জজকোর্টের সব সিনিয়র-জুনিয়র সিভিলের আরজি-জবাব, ক্রিমিনালের জামিন-নালিশি দরখাস্ত সবই করতে লাগলেন খাস বাংলাতে। জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরাও রায়-আদেশ-ডিক্রি সব দিতে লাগলেন বাংলাতেই।
জুনিয়রগিরি চুকিয়ে ১৯৮৮-র ফেব্রুয়ারিতে ঢুকলাম জজিয়তিতে। এলাম উপজেলা আদালতে, ভিন্ন এক জেলায়। দেখি সে-জেলার সব আদালতে বাংলাই চলছে, ইংরেজির পাত্তা নেই কোনোখানে। দেশের জেলায় জেলায় সব আদালতে বাংলা চালু হয়ে গেছে জোরেশোরে। দিনে দিনে বাংলা ততদিনে পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে অধস্তন সব আদালতে, ইংরেজি ভেগেছে পাততাড়ি গুটিয়ে। তক্ষুনি খবর হলো, কাম সারছে! হাইকোর্টের রায় হয়ে গেছে, ইংরেজিটাও চলবে আগেকার মতো। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটাই চলবে না আর অধস্তন আদালতে (হাইকোর্টে আইনটা চলেইনি মোটে)।
উপজেলার সব আদালতে সরকারি গেজেট আর ডিএলআর-এর নিয়মিত বরাদ্দ ছিল, সরাসরি আসত ডাকে। ডিএলআর আসত দুমাসের দুটি ইস্যু একসঙ্গে। ১৯৯২-এর মাঝামাঝিতে পাওয়া গেল ৪৪ ডিএলআর ৩৩২ পৃষ্ঠায় হাইকোর্টের সেই রায়, হাসমতউল্লাহ বনাম আজমিরি বিবি গং মামলার। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ হলো ভঞ্জ। ইংরেজিতেই লেখা রায় ১৯৯১-এর ২৮ নভেম্বরে। ফ্যাসাদটা বেধেছিল সিভিলেই। অধস্তন কোনও এক (নামধাম নেই সেই রায়ে) আদালতে ইংরেজি আরজি-জবাব নিয়ে চলে আসা পুরাতন এক মামলায় বাদীর আইনজীবী অস্থায়ী-নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত ইংরেজিতে করেন ১৯৮৭-এর ২২ মার্চে। অর্থাৎ কিনা, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা প্রচলন হবার ১৯ দিন পরে (আইন ভাঙার বুদ্ধি ছিল ঘটে)! বিবাদীর আইনজীবীও লিখিত আপত্তিটা দেন ইংরেজিতে (বুদ্ধিতে কম কিসে!) ১৯৮৭-র ৩১ মার্চে। ইংরেজিতে লেখা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার দরখাস্তটা রেখে বাংলায় ছাড়া চলবে না বলে আদালত প্রত্যখ্যান করেন শুধু ইংরেজিতে লেখা আপত্তিপত্রটা (একটা পক্ষে তো যেতেই হয় আদালতকে!)। ঠ্যালা সামলাতে ইংরেজি-বিবাদী হাইকোর্টে রিভিশনে আসে ১৯৮৭-তেই। ১৯৮৯-তে আরেকটা, ১৯৯০-তে ৬টা, ১৯৯১-তে ১০টা, সব মিলে আরও ১৭টা মামলা আইনজীবীরা দাখিল করেন ইংরেজিতে লেখা আরজি দিয়ে (আদালতের নামধাম নেই সেই রায়ে)। বাংলায় ছাড়া চলবে না বলে বিবাদীরা সব আরজি প্রত্যাখ্যানের দরখাস্ত দিলে সব কটাই যার যার আদালতে নামঞ্জুর হয় যার যার সালে। ঠ্যালা সামলাতে বাংলা-বিবাদীরাও রিভিশনে আসে হাইকোর্টে যার যার সালে।
সেই ১৮টা রিভিশনের একসঙ্গে শুনানি হয় দ্বৈত বেঞ্চে, ফয়সালা হয় এক রায়ে। ইংরেজিওয়ালাদের ছিল বাঘা বাঘা সব আইনজীবী। তারা আগে কেউ বিচারপতি, কেউ অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন, পরে কেউ বিচারপতি, কেউ অ্যাটর্নি জেনারেল হন, বাকিরা পরে বাঘা হন আরও। হেরে যায় বাংলা, জিতে যায় ইংরেজি, যুক্তির মারপ্যাঁচে। সেই সনাতন যুক্তি, ফাঁক আছে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনেই! সেই ফাঁকে পেনাল্টি গোল পেয়ে জিতে যায় ইংরেজি বাংলার বিচারালয়ে! অধস্তন আদালতের ভাষার যেসব বিধান আছে দেওয়ানি-ফৌজদারি কার্যবিধিতে তাতে ইংরেজিও চলার কথা লেখা আছে। সংশোধন করা হয়নি সেসব, বাতিলও করা হয়নি নাম ধরে। আদালতের ভাষার ব্যাপারে কার্যবিধি দুটোই ‘বিশেষ আইন’ (স্পেশাল ল), আর ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ হলো ‘সাধারণ আইন’ (জেনারেল ল) মাত্র। বিশেষ আইনের বিশেষ বিধান ভেসে যায় না সাধারণ আইনের পাইকারি কথার তোড়ে। আইন প্রণেতাদের জানা সবই।
আদালতে ইংরেজি চলা বন্ধ করার ইচ্ছাটা যদি সত্যিই তাদের থাকত, তবে তো কার্যবিধি দুটোতেও একটু কাটাকুটি করতেন, কাটাকুটিটা বাংলা ভাষা প্রচলন আইনেও তো একটু লিখতেন! বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা হয়েছে সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের দোহাইয়ে। সে অনুচ্ছেদ তো রাষ্ট্রভাষার। রাষ্ট্রভাষা বিশাল সিন্ধু ব্যাপার! সেই সিন্ধুর গভীরে দপ্তরের ভাষা (অফিসিয়াল ল্যাঙগুয়েজ), আদালতের ভাষা (কোর্ট ল্যাংগুয়েজ), এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব বিন্দু থাকে। বিশাল সিন্ধু শুধু রাষ্ট্রভাষা প্রচলনের কথাতে ক্ষুদ্র এক বিন্দু আদালতের ভাষার কথা টের পাওয়া যায় না ঘুণাক্ষরেও। আদালতের ভাষা ঠিক করে দেবার ক্ষমতা সরকারের আছে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারাতে। কিছুই তো করেনি সে-দুটো দিয়ে।
সুতরাং, আদালতে ইংরেজিও চলবে যেমন চলে আসছিল রাষ্ট্রভাষা প্রচলনের আগে থেকে। নিম্ন আদালত ঠিক করেছে ১৭ বার ইংরেজিতে লেখা আরজি গ্রহণ করে, আর ভুল করেছে পয়লাই শুধু ইংরেজিতে লেখা আপত্তিপত্রটা প্রত্যাখ্যান করে! হৃদয় জুড়াল ইংরেজির, জেঁকে বসল আবার অধস্তন আদালতে। সুপ্রিম কোর্টে তো তার আসন টলেইনি। বোঝা গেল, আইন না মানা স্বভাব কেন বেশি এদেশে! আইনের ফাঁক আর ফাঁক ধরা ওস্তাদে ভরা (কোনটা যে বেশি কে দেখে হিসেব কষে!) দেশে আইন মানে কিছু ভিতু বোকাতে! দাপুটেরা বুদ্ধিমান, জানে ভাঙলেই ফাঁক বেরুবে আইনে, অভাব হবে না ফাঁক ধরা ওস্তাদের!
ছা-পোষা বাঙালি ততদিনে মজেছি বাংলাতে। বাংলাটা বিদায় করেনি তাইতে রক্ষে! জজিয়তিটা শেষ করি বাংলাতেই। বছরে দুটো করে ইংরেজি রায় লিখতে হয়েছে নিতান্তই এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেন) বাঁচাতে, পাছে পদোন্নতিতে না পিছলে পড়ি সেই ভয়ে। তাতেই ভোগায় পাপবোধে! ইংরেজ তো কেউ ছিল না মামলার কোনও পক্ষে। ইংরেজিতে রায় চায়নি কোন মক্কেলে। বাঙালি বিচারকের দেওয়া ডিক্রি-ডিসমিস, সাজা-খালাসের মর্ম বুঝতে বাঙালি মক্কেলকে ইংরেজি মাস্টার ধরতে হবে!
এসবের ফয়সালা হয়নি হাইকোর্টের রায়টাতে। আপিল বিভাগে যায়নি আর ১৮ মামলার কেউ। বাঙালিকে হাইকোর্ট দেখিয়েই শেষ! হাইকোর্ট পর্যন্ত আসতে-লড়তেই দম ফুরিয়েছে বাংলা-বিবাদীদের, আশা-ভরসা সব শেষ। সরকারের দম ফুরাল কিসে! সংসদ চলে বাংলায়, আইন-বিধি হয় বাংলাতে। সরকারি সব দপ্তর চলে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের কথাতে। চলে না কেবল আদালত, সে-আইনে পরিষ্কার লেখা থাকা সত্ত্বেও। চলে ব্রিটিশি চালে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার আর কি প্রমাণ লাগে!
নিজেদের করা আইনের প্রয়োগে ব্যর্থতা মেনে সরকার নির্বিকার হাইকোর্টের এক কথাতে। আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ তো করার ছিল সরকারি স্বার্থে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, জনস্বার্থে!
বলার ছিল, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা সামরিক ফরমানে নয়, হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের মালিক” (অনুচ্ছেদ ৭) যেই জনগণ সেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদে। হয়েছে “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্ত” (অনুচ্ছেদ ৭) যেই সংবিধান সেই সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদের জোরে। যেখানে জনগণ একবাক্যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে কেবল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, রাষ্ট্রের সব কার্যালয়ে বিচারালয়ে আচার বিচার সব নিশ্চিত বাংলায় পাবে বলে।
বলার ছিল, সেই অভিপ্রায় ব্যক্তের সঙ্গে সঙ্গেই সব কার্যালয়ে, বিচারালয়ে আচার বিচার সব বাংলায় পাবার ছিল জনগণের। কার্যালয় বিচারালয়গুলো সেই অভিপ্রায় পাত্তা না দিয়ে ১৫ বছর ধরে বেয়াড়াপনা বেয়াদবি করে এসেছে মালিকের সঙ্গে। সেই চরম অবাধ্যতা থামাতে এই বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটা হয় জাতীয় সংসদে, সংবিধানের রাষ্ট্রভাষার বিধানমতে।
বলার ছিল, সংবিধানের চেয়ে বড় নয় কোনও কার্যবিধি। কার্যবিধির যে বিধান সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস লাগে সে-বিধানটাই বাতিল বলেই জনগণের অভিপ্রায় রাখা আছে (অনুচ্ছেদ ৭ ও ২৬)। বাতিল ঘোষণার এক্তিয়ারটা দেওয়া আছে হাইকোর্টকেই। সেই আমানতের খেয়ানত মানায় না সর্বোচ্চ বিচারালয়ে।
বলার ছিল, সংবিধানমতে বিচারালয়ে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটাই চলে, চলে না আর দেওয়ানি-ফৌজদারি কার্যবিধির ওসব বিধান। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন চলার কথা সুপ্রিম কোর্টেও, চলবে না সংবিধানের সঙ্গে বেখাপ্পা আইন-বিধি। আদালত অর্থে সুপ্রিম কোর্টকেও ধরে রেখেছে জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে (১৫২ অনুচ্ছেদে)। বলার ছিল, হাইকোর্ট বিভাগের সেই রায়ে ভুল হয়েছে এখানটাতে, ভুল হয়েছে ইংরেজিতে রায়টা লেখাতেও।
আপিল করেনি সরকার। তবে কি সত্যি সদিচ্ছা ছিল না বিচারালয়ে বাংলা ভাষা প্রচলনের! আপিলটা হলে দেখার ছিল, বাংলার স্বাধীন দেশে কার ভাষাটা আদালতের ভাষা হবে! কার ভাষাতে আরজি-জবাব, রিট-পিটিশন, রুলনিশি, রায়-ডিক্রি, আদেশ লেখা হবে! আইনজীবীর, নাকি বিচারকের, নাকি বিচার চাওয়া মক্কেলের ভাষাতে! লেখা হবে কার অভিপ্রায়ে! জানা যেত, সেই ১৮ মামলায় ইংরেজি জানা মক্কেল ছিল কতজনা! আপত্তিপত্র, আরজিগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল কি পয়সা দেওয়া মক্কেলের অভিপ্রায়ে! আদালতে ঘোরা মক্কেলের কতভাগ ইংরেজি জানা! বিচার পাওয়ার সঙ্গে বোধগম্য ভাষায় বিচার পাওয়াটাও বিচারপ্রার্থীর মৌলিক অধিকার বটে।
বিচার করাই তো যথেষ্ট নয়, সঠিক বিচারই যে হলো সেটাও তো বোঝাবার কথা বিচারের নীতিতে। প্রিভি কাউন্সিলে বিচার যায় না আর। অবাঙালি মক্কেল দু-একজন যদিওবা কখনও জোটে, অবাঙালি কোনও বিচারক, আইনজীবী জুটবে না এদেশে। ইংরেজিটা তবে কিসের জন্যে! বাঙালির বিচারের কথা বাঙালি বিচারক, বাঙালি আইনজীবী বাংলায় লিখতে জানেন না বলে ভাবতেও তো লজ্জা লাগে! খেয়ালখুশিতে দু-একটা যদি বাংলায় লেখা যায় তবে নিশ্চয় যায় সবটাই।
অধস্তন আদালতে যেটুকু বাংলার চল সেটুকু ওই ব্রিটিশেরই বদৌলতে। তার আগে বাংলা ছিল না বাংলার কোনও বিচারালয়ে। তুর্কি, পাঠান হয়ে মুঘল আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ ভারতের সব মুলুকে দরবারের ভাষা, আদালতের ভাষা ছিল ফারসি। ১৭৯৩ ও ১৭৯৭-এর রেগুলেশনে নিম্ন আদালতে দেশি ভাষায় সাক্ষী নেওয়া দিয়ে শুরু ব্রিটিশের। ফারসি উঠিয়ে ভারতীয় ভাষাগুলোকে নিম্ন আদালতের ভাষা করতে চায় খরচ বাঁচাতে। ব্রিটিশকেও সেকাজে বেগ পেতে হয় ব্রিটিশ বিচারকদের কাছেই। শেষে লর্ড অকল্যান্ডের আমলে ১৮৩৭-এর ২৯ নম্বর আইনে গভর্নর জেনারেল ক্ষমতা পায় ভারতীয় ভাষাগুলোকে যার যার মুলুকে নিম্ন আদালতের ভাষা করার। শুরু হয় দেশি ভাষাকে নিম্ন আদালতের ভাষা করা, ইংরেজিটা সঙ্গে রাখা হয় যদি কারও ইচ্ছা করে তবে। বাংলা মুলুকের নিম্ন আদালতের ভাষা হলো বাংলা, সঙ্গে রইল ইংরেজি, যদি কারও ইচ্ছা করে তবে। ফল হলো ঠিক উল্টো, ইংরেজিকেই আদালতের ভাষা মানে, বাংলাটা চলে ইচ্ছার ওপরে।
স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারালয়ে বাংলা কি আর ইচ্ছাধীন থাকা চলে! স্বাধীনতার পরে ভারত অফিস-আদালতের কাজে ইংরেজিকে সংবিধানেই রেখেছে ‘অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ’ হিন্দির পাশে। ভিন্ন ভাষাভাষীর বহু রাজ্য আর অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রাখার একটা যুক্তি পায় তারা, ইংরজিটা রেখেছেও রাখ-ঢাক না করেই। কোথায় কতটুকু কোন ভাষা চলবে তারও বিধান করেছে সংবিধানে আলাদা একটা ‘পার্ট’ করে ৪টা চ্যাপ্টারে ৯টা অনুচ্ছেদে। আদালতের ভাষার জন্য আলাদা একটা চ্যাপ্টারও করেছে। সেখানে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের ভাষার চলও ঠিক করা আছে।
পাকিস্তানের কথা তুললেই তো ভাষা আন্দোলনের কথা চলে আসে, রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা পাবার কথা মনে পড়ে! ভিন্ন ভাষাভাষীর কিছু প্রদেশের দেশ পাকিস্তানের সংবিধানেও অফিস-আদালতের কাজে ইংরেজি চলার বিধান ছিল, আছে এখনও। তারাও একই যুক্তি পায় ভারতের মতো।
দেশ ছাড়া আমাদের নেই কোনও প্রদেশ, নিরানব্বই শতাংশ বাঙালির ভিন্ন কোনও ভাষাও নেই বাংলা ছাড়া। হুজ্জতি ছাড়া কোনও যুক্তি নেই। সংবিধানে তাই “রাষ্ট্রভাষা বাংলা” বলেই শেষ। তাতেও যখন পোষায় না হুজ্জতে বাঙালির তখন সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগের ভাষার একটা অনুচ্ছেদ বসালেই তো মিটে। যেখানে লেখা থাকবে, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন সকল আদালতে বিচারের যাবতীয় কার্য অবশ্যই বাংলা ভাষায় সম্পাদন হইবে। মামলামোকদ্দমার এক পক্ষে অবাঙালি থাকিলে বাংলার সহিত আদালতের অনুমোদিত ইংরেজি অনুবাদ অতিরিক্ত হিসাবে চলিবে। কোনও পক্ষেই কোনও বাঙালি না থাকিলে সেই ক্ষেত্রে কেবল ইংরেজি চলিবে।’’
এর সঙ্গে মিলিয়ে আদালতের ভাষার একটা আইন করলেই হয় দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা দিয়ে। সেইমতো হাইকোর্ট আর আপিল বিভাগের রুলসে ভাষার বিধান মিলিয়ে নিলেই হয়। মেরামত করলেই হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে হাইকোর্টের রায়ে ধরা ফাঁকগুলোর সংশোধনী দিয়ে। সবই করা যায় রক্তে পাওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার ন্যায্য পাওনাটা দিতে, হুজ্জতিটা একটু ছাড়লে, সদিচ্ছাটা সত্যি সত্যি থাকলে।
(সমাপ্ত)
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।ইমেইল: [email protected]