আওয়ামী লীগের শাসনকালে শিল্পকলায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তীরন্দাজ নাট্যদলের একটি নাটক; ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেই শাসন অবসানের পর যখন মুক্তির আনন্দ দোলা দিচ্ছিল অনেকের মনে, তখন আবার বিক্ষোভের মুখে নাটক বন্ধ হলো সেই শিল্পকলায়।
দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’র প্রদর্শনী শনিবার বন্ধ হওয়ার ঘটনার পর নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।
“স্বৈরাচার হাসিনার বাহিনীকে ডরাই নাই আর আপ্নেরা কেডা নাটক বন্ধ করেন?” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন শিক্ষক ও নাট্যকর্মী সামিনা লুৎফা নিত্রা।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় শনিবার সন্ধ্যায় দেশ নাটকের প্রযোজনায় মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চ নাটক ‘নিত্যপুরাণ’ এর শো চলছিল।
দেশ নাটকের এহসানুল এজাজ বাবুর এক ফেইসবুক পোস্ট ধরে আপত্তি তুলে একদল শো শুরুর সময় ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে নাট্যশালার সামনে।
তাদের বিক্ষোভের মুখে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে শো বন্ধের ঘোষণা দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ। এই শিক্ষক ও নাট্যনির্দেশক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিল্পকলার দায়িত্বে আসেন।
নাটক বন্ধ করে দেওয়ায় সৈয়দ জামিল আহমেদের সমালোচনা করে ফেইসবুকে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা নিত্রা, যিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
নিত্যপুরাণ’র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ আমলে সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদ করায় তীরন্দাজ নাট্যদলের একটি নাটকের শো বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গটি আনেন।
শিল্পকলার তৎকালীন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ওই নাট্যদলটিকে দীর্ঘদিন শিল্পকলায় নাটকটি প্রদর্শনের জন্য হল বরাদ্দ দেয়নি। বিষয়টি নিয়ে তখন সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই চুপ থাকলেও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সামিনা লুৎফা ও তার নাট্যদল বটতলা। বটতলাকেও প্রায় ১৮ মাস নাটক মঞ্চায়নের জন্য হল বরাদ্দ দেয়নি শিল্পকলা।
সৈয়দ জামিল আহমেদের সমালোচনা করে সামিনা লিখেছেন, “আজকে যিনি নিজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে একটি অন্যায্য কাজ করলেন একটি দলের প্রদর্শনী মাঝ পথে বন্ধ করে, তার মেরুদণ্ডের অনেক গল্প শুনে বড় হয়েছি বলেই বড় করে বাজলো প্রশ্নটা: সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে নাটক, কথা, জীবন বন্ধ করত শেখ হাসিনার সরকার, আপনি কেন নাটক বন্ধ করলেন?
“যাদের এতটুকু সাহস নেই যে তারা নাটককে নাটক দিয়ে প্রতিরোধ করবে, তাদের কথায় নাটক বন্ধ করার মতো গর্হিত কাজ কেন করবেন আপনি?”
দেশ নাটকের বন্ধ প্রদর্শনী পুনরায় আয়োজন করতে দেওয়ার দাবি জানিয়ে সামিনা লিখেছেন, “আশা করি, তারা আবার শো’টা করবেন। দেখি কে আটকাতে আসে! নাট্যকর্মীরা সবাই পাহারা দেব- দেখি কার সাহস! স্বৈরাচার হাসিনার বাহিনীকে ডরাই নাই আর আপ্নেরা কেডা নাটক বন্ধ করেন! আগুন লাগাবে, শিল্পকলায়? বললেই হইলো আর কী!”
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল, দেশ নাটকের এহসানুল আজিজ বাবু ফেইসবুকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কটূক্তি করে পোস্ট দিয়েছেন। তাই তাকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাদের ব্যানারেও এই কথা লেখা ছিল।
নাট্যকর্মীদের ক্ষোভের বিপরীতে রবিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পকলার মহাপরিচালক জামিল আহমেদ বলেছেন, নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে।
“সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ২২ জায়গায় শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা হয়েছে। সেসব মাথায় ছিল। আর এখানে ভেতরে দর্শক ছিল। উত্তেজিত কেউ গিয়ে যদি দর্শকদেরও আক্রমণ করে বসে? দর্শকের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা প্রদর্শনী বন্ধ করি। আমি ভেতরে গিয়ে দর্শকের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলার সময় েথকে শিল্পকলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকার পরও কেন বিক্ষোভকারীদের ঠেকানো গেল না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন সামিনা লুৎফা।
“যেই আর্মি শিল্পকলায় থাকার কারণে সাধারণ নাট্যকর্মীদের যাতায়াত বন্ধ, সে আর্মি যদি শিল্পকলার বিপদে নিরাপত্তা না দেয়, সেই আর্মি সরান! আমাদের শিল্পকলা আমাদের হাতে ছাড়েন!”
নাট্যকার মাসুম রেজা অবশ্য শিল্পকলার মহাপরিচালককে দায়ী করছেন না। তিনি শনিবারই সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “জামিল আহমেদ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।”
দেশ নাটকের সদস্য বন্যা মির্জাও লিখেছেন, “সৈয়দ জামিল আহমেদ নিজে গেছেন এর ভিতর, কারণ ততক্ষণে তিনি বুঝেছেন, কোনও আইনি সহায়তা পাবেন না। আর তিনি ডিজি হয়েছেন মানে, তিনি কাজটি করতেই ডিজি হবার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। তিনি মোটেই সেই মানুষ নন যিনি নাটক বন্ধ করতে বলবেন। দেশ নাটকেরও কেউ সেটা বলছেন না।”
দেশ নাটকের দলপ্রধান নেই জানিয়ে বন্যা লিখেছেন, “দেশ নাটকে কোনও দলপ্রধান নেই। একটা দলে কমিটি থাকতে হয়। এটাই নিয়ম। আর নিয়ম করে সেটা কেউ না কেউ থাকেন। তবে অনেক দলেই দলীয় প্রধান থাকেন ও সারা জীবন তিনিই থাকেন। এমনও হয়। তো এই কথা থিয়েটারের বাইরে কারও বোঝার কথা না। কিন্তু সবাই এত বুঝে গেলেন!”
বিক্ষোভকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ না পেলেও বন্যা মির্জা ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ শক্তিই এ কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।
“যে ব্যানারের ছবি দেখেছি, তা বাইরের কারও করা বলে মনে হচ্ছে না। ব্যানার কি তৈরি করা ছিল? লোকেরা ব্যানার সমেত নাটক বন্ধ করতে এসেছিল! এটা দেখেই তো বোঝা যায় কে বা কারা করেছে। এটি ‘বিভীষণ’ কাজ। যিনি বা যারা করেছেন, তাদের আনসেকসেসফুল পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার নিয়ে ঘুমাতে পারছেন না। অন্যখানে শক্তি ক্ষয় করে চলেছেন।”
আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদও দেশ নাটকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “দেশ নাটকের বন্ধ প্রদর্শনী ফেরত দিতে হবে, নাটক কম করবো না পিও, নাটক হবেই হবে!”
উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষার বলেছেন, “সৈয়দ জামিল আহমেদের পদত্যাগ করা উচিৎ। মঞ্চ অভিনয়ের জায়গা। রাজনীতির কালো ছায়া মঞ্চে পড়তে দিলে আর তাকে কেন দরকার? এসব হতে দিলে এটার জন্য তিনি কেন?”
দেশ নাটকের প্রদর্শনী বন্ধে হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রবীণ নাট্যজন মামুনুর রশীদ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা খুবই দুঃজনক। খুবই দুঃখজনক। নানা জায়গা থেকে নানা প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি।”
বিষয়টি নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সোমবার বৈঠকে বসে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পুনর্গঠন ও সংস্কার কমিটির প্রধান মামনুর রশীদ।
প্রবীণ নাট্যজন তারিক আনাম খান নাটকের প্রদর্শনী বন্ধের সমালোচনা করলেও দেশ নাটকের বাবুর দায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যতটুক শুনেছি, নাট্যদলটির একজন সংগঠক ফেইসবুকে এমন একটি পোস্ট দিয়েছেন, যা খুব গণতান্ত্রিক নয়, মকারি করে বিদ্রুপমূলক পোস্ট ছিল। রাজনীতি করা সবারই অধিকার আছে, কিন্তু যখন একটি দলের নেতা হন, তার কিছু দায়িত্বও থেকে যায়।
“যাই হোক কিছু লোক এতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মহাপরিচালক মহোদয়ও তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন নাটকটির শো কন্টিনিউ করতে। হয়ত পারেননি। কিন্তু একজন লোকের জন্য একটি দলের শো বন্ধ করে দেওয়াটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আইনের চোখে যদি দোষি হয়, তার শাস্তি আইনত হওয়া উচিৎ। হুমকি দিয়ে নাটকের মঞ্চ জ্বালিয়ে দেব, পুড়িয়ে দেব, এ ধরনের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং অত্যন্ত দুঃখজনক।”
“দীর্ঘদিন ধরে আমরা নাট্যান্দোলন করে এসেছি, তার ফলেই শিল্পকলা এমন মঞ্চ পেয়েছে, এমন কাঠামোয় দাঁড়িয়েছে। পুরো বিষয়টা নিয়ে অনেক কষ্ট পাচ্ছি,” বলেন তারিক আনাম।
ঢাকায় নিত্যপুরাণ’র শো বন্ধের দিনই ‘তৌহিদী জনতা’র রোষের মুখে পড়ে চট্টগ্রামে একটি শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়ে তা না করেই ফিরে আসেন অভিনয়শিল্পী মেহজাবিন চৌধুরী।
দুটি ঘটনার মিল দেখিয়ে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন, “১০ জন কি ২০ জন মানুষ একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে দাবি করলেই একটা নাটক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? একজন অভিনয়শিল্পী চট্টগ্রামে গেছেন একটা দোকান উদ্বোধন করতে, সেটা করতে পারেননি ‘তৌহিদি জনতা’র বাধায়।
“আগামী দিনগুেলাতে আরও কতকিছু দেখতে পাব। জামিল আহমেদকে একা দোষ দিয়ে কী লাভ!”