ভরদুপুরে ভ্যাপসা গরমে বসে মিরনজুল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় বারান্দায় ভাত খাচ্ছিলেন শংকর দাশ। ৬৯ বছর বয়সী এই বৃদ্ধের পাতে অল্প একটু ভাত, তার সঙ্গে সিঁদল শুঁটকি ভর্তা আর ডাল।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অভিযানে ভাঙা পড়েছে শংকর দাশের ঘরও। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়েছেন এই প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে।
শুধু শংকর দাশ নন, মিরনজুল্লাহ হরিজন সিটি কলোনির প্রায় ২০টি পরিবারের বাড়ি ভাঙা হয়েছে। আরও ১২০টির মতো পরিবারও ঘর হারানোর শঙ্কায়।
হরিজন ঐক্য পরিষদের নেতারা দুদিন সময় নিয়ে এসেছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের কাকুতি-মিনতি করে। বলে এসেছেন, দুই দিনের মধ্যে তারা নিজেরাই নিজেদের ভিটা ছেড়ে দেবেন। তাই মঙ্গলবার রাতে আর বুলডোজার চলেনি।
এখন কোথায় যাবেন- এই প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন শংকর; এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সারাজীবন এই শহরের হাগা-মুতা সাফ করছি। এখন এই শহরে আমার জায়গা নাই।”
পুরান ঢাকার বংশালের মিরনজুল্লাহ কলোনির একটি অংশে আধুনিক কাঁচাবাজার নির্মাণ করতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এজন্য সেখানে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চলছে।
মিরনজুল্লাহ কলোনিতে ৩ দশমিক ২৭ একর জমি রয়েছে। এই ৩২৭ শতাংশের মধ্যে ২৭ শতাংশ জমিতে আধুনিক কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হবে। এ জমির মধ্যে অর্ধেকের মতো জায়গায় আগে থেকেই কাঁচাবাজার রয়েছে।
মিরনজুল্লাহ কলোনির যে অংশটি ভেঙে ডিএসসিসি আধুনিক কাঁচাবাজার করতে চায়, সেখানে অন্তত ১০০টি হরিজন পরিবার বসবাস করছে, গাদাগাদি সব ঘরে।
‘বাড়ি-ঘর রাইখ্যা যামু কই’
শংকর দাশ তার ফেলে আসা জীবনের পুরোটাই কাটিয়ে দিয়েছেন মিরনজুল্লাহ কলোনিতে, আর করেছেন শহরের ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্ন করার কাজ।
তার প্রশ্ন- “যাব কই দাদা? এহানেই বাড়ি। ছোট থেকে এহানেই সব। হামাদের বাড়ি-ঘর রাইখ্যা যামু কই?”
গত ৯ জুন এই কলোনিতে বসবাস করা ৬৬ জনের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দিয়েছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তবে কলোনির বাসিন্দারা বলছেন, জোর করে চাবি নিতে বাধ্য করা হয়েছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের।
মিরনজুল্লাহর সুইপার কলোনিতে অন্তত ৬ হাজার লোকের বাস বলে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। কেউ কেউ সংখ্যাটি আরও বেশি বলছেন। এখানে একটি মন্দির ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হলেও তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে খোদ সিটি করপোরেশনই।
তারা বলছে, সাচিবিক আদেশে নিয়োগ পাওয়া স্থায়ী কর্মীরাই কেবল ফ্ল্যাট পাবেন। অস্থায়ী কর্মীদের ঘর দেওয়া হবে না।
কলোনির বাসিন্দারা বলছেন, স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন। অথচ এখানে প্রায় ৭০০ পরিবার বাস করে।
যারা ঘর পেয়েছেন, তারা কেউ চাবি নেননি। তাদের দাবি, সবাইকে ঘর দিতে হবে। না হলে তারাও নতুন ঘরে উঠবে না।
কলোনির আরেক বাসিন্দা হেমন্ত দাশ বলেন, “কোথা থেকে ৬৬ জন বাসা নিছে। নিছে শুধু ৬ পরিবার। তারাও আমাদের সম্প্রদায়ের নয়। মুসলিমরা নিছে। আমরা ওইখানে উঠব না কি? উঠলে যারা জায়গা পাবে না, তাদের সাথে বেইমানি করা হবে।”
কলোনির বাসিন্দারা জানান, আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে শুধু হরিজনরাই কাজ করত। কিন্তু গত কয়েক বছরে মুসলমানরাও এই পেশায় যুক্ত হয়েছে।
গত রবিবার হরিজন সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি হরিজন পল্লী এখনই উচ্ছেদ না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
প্রতিনিধি দলের ভাষ্য, বৈঠকে মেয়র বলেছিলেন, ভবন নির্মাণের জন্য বস্তির অল্প জায়গা ভাঙা হবে; বাইরে পুরো বস্তি থাকবে। সেই আশ্বাসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বস্তি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়ে যায়।
এর আগে গত ৭ জুন হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যরা নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে। তাদের দাবি ছিল, পুর্নবাসন ছাড়া যেন তাদের উচ্ছেদ করা না হয়।
এই কলোনির যেভাবে পত্তন
জনশ্রুতি আছে, চারশ বছর আগে থেকে এই কলোনির গোড়াপত্তন। বাংলাদেশে হরিজন বলতে বোঝায় মূলত ব্রিটিশ আমলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন, চা বাগান, রেলের কাজসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ভারতের নানা অঞ্চল থেকে আনা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এরপর থেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে এখানেই তাদের বসবাস। এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় তারা।
এলাকার বাসিন্দারা জানাল, মিরন বাই নামে একজন নামকরা বাঈজী মূলত এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনিই এটা হরিজনদের দিয়ে যান। স্বাধীনের পর এ কলোনির নিয়ন্ত্রণ যায় সিটি করপোরেশনের হাতে।
এখন সরকারি স্কুলটির নাম মিরনজুল্লাহ প্রাথমিক বিদ্যালয় হলেও দোকানের সাইনবোর্ডে কোথাও মিরনজল্লা, কোথাওবা মিরনজিল্লা নামটিও দেখা যায়।
কথা হচ্ছিল নিপুণ দাশের সঙ্গে। তিনিও সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে কাজ করেন। তিনি শুনেছেন, তার পূর্বপুরুষ ভারতের এলাহাবাদে ছিল।
নিপুণ বলেন, “আমাদের তো এখানে এই কলোনি বাদে আর কিছু নেই। আমাদের স্থায়ী ঠিকানা এখানেই। এখন যদি বের করে দেয়, আমরা কই যাব?”
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই কলোনির বাসিন্দাদের অবদান ছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক বিপরীতেই যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি শহীদ মিনার।
১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডের মিরন জল্লা হরিজন সিটি কলোনি থেকে চিরতরে হারিয়ে যান ১০ জন। রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানি বাহিনী তাদে হত্যা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য তাদের প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
সেই ১০ জনের নামও রয়েছে শহীদ মিনারের সামনে এক ফলকে। শুধু হরিজন হওয়ার কারণে তাদের ভাগ্যে কোনও স্বীকৃতি জোটেনি বলে জানান কলোনির বাসিন্দারা।
বিকল্প ব্যবস্থার আশ্বাস, তবে কতদিনে?
হরিজন কলোনির বাসিন্দাদের জন্য সিটি করপোরেশনের বিকল্প ব্যবস্থা করার ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলার আউয়াল হোসেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে ভূল বোঝাবুঝি হচ্ছে। এখানে কাঁচাবাজার কমপ্লেক্স হওয়ার সাথে সাথে আরও তিনটি ভবন হবে। সবগুলো ভবন হবে ১০ তলা। সেখানে তাদের জায়গা হবে।”
ভবন হওয়ার আগে এই মানুষগুলো কোথায় যাবে- প্রশ্ন করা হলে তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি এই কাউন্সিলার।
তিনি বলেন, “এরকম একটা কাজ করতে তো তিন-চার বছর লাগবেই। আমরা চেষ্টা করব, তাদের অন্য কলোনিতে থাকার ব্যবস্থা করতে।”
ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, হরিজন পল্লীর অনেক জনের থাকার জন্যই বিকল্প ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়েছে৷ বাকিদের অন্যান্য কলোনিতে স্থানান্তর করা হবে।
কবে নাগাদ পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, জানতে চাইলে তিনিও কোনও নির্দিষ্ট সময় বলতে পারেননি।
এদিকে কলোনির বাসিন্দারা বলছেন, তাদের আশপাশে থাকার পথও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কাউন্সিলরের লোকজন এলাকায় বলে দিয়েছেন, কেউ যেন হরিজনদের বাসা ভাড়া না দেয়।
কলোনিকে মাদকের আখড়া হিসাবে প্রমাণ করতেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা উঠে পড়ে লেগেছে বলে হরিজনদের অভিযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলোনির এক বাসিন্দা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা মাদক ব্যবসা করি বলি সবাইকে বলা হয়। আপনি দাদা খোঁজ নেন, দেখেন আমাদের কারও নামে এরকম কোনও মামলা আছে কি না?
“আমরা শুধু ড্রেনে হাগা-মুতা পরিষ্কার করতে যখন নামি, তখন চুল্লু (দেশি মদ) খাই। বোঝেনই তো দাদা, এই গন্ধে তো তা না খেলে কাজ করতে পারি না।”
কলোনির বাসিন্দাদের এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন কাউন্সিলার আউয়াল। তিনি বলেন, “এগুলো সবই মিথ্যা কথা। কেউ কেউ সুবিধা নেওয়ার জন্য এসব বানিয়ে বলছে। আমি আমার এলাকার উন্নয়নের জন্যই শুধু কাজ করছি। এটা এলাকাবাসী জানে।”