দেশের পুঁজিবাজারে তেজিভাব ফিরেছে। আস্থায় ফেরা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার কেনার ঝোঁক বেড়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির প্রান্তিকের আয়ের ইতবাচক খবরে সেসব শেয়ারে ক্রয়চাপ বেড়েছে। বড় মূলধনি কোম্পানি ঘিরেও বিনিয়োগে ঝুঁকছেন সচেতন অনেকে।
ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যসীমা তুলে নেওয়ার ধাক্কা কাটিয়ে উঠা পুঁজিবাজারে লেনদেনের পাশাপাশি বাড়ছে মূলসূচক। দীর্ঘ মন্দায় যারা এতদিন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসছেন। ফলে বাড়ছে ক্রয়চাপ।
এ অবস্থায় সোমবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন ১৬০০ কোটি টকা ছাড়িয়েছে। টানা ৬ দিন এই বাজারের প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্সে যোগ হয়েছে ২৪৩ পয়েন্ট।
গত সপ্তাহে টানা চার দিন সূচক বেড়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার ও পরের দিন সোমবার সূচকের বেশ উত্থান দেখা গেছে। ১৬ মাস পর রবিবার লেনদেন দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়।
পুঁজিবাজারের এই তেজিভাবে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। সামনের দিনগুলোতে বাজার আরও ভালো হবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা।
সোমবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪১ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৩২২ দশমিক ৬০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১ হাজার ৬৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ৭৫ কোটি টাকা বেশি।
রবিবার এই বাজারে এক হাজার ১ হাজার ৫৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল, যা ছিল ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
অন্য বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৮৭ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট বেড়ে ১৮ হাজার ৩২ দশমিক ২৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। লেনদেন হয়েছে ১৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহের চার দিনে (সোম, মঙ্গল,বুধ ও বৃহস্পতিবার) ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩৫ পয়েন্ট বেড়েছিল; রবিবার বাড়ে ৬৭ পয়েন্ট। সবশেষ সোমবার বেড়েছে ৪২ পয়েন্টের মতো।
সব মিলিয়ে এই ছয় কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৪৩ পয়েন্ট বেড়েছে। সিএসইতেও এই ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ফ্লোর প্রাইস উঠার পর দুই দিন ভালোর ইঙ্গিত দিলেও পরে ফের দরপতন শুরু হয় বাজারে। টানা তিন কার্যদিবস দুই বাজারেই মূল্যসূচকের বড় পতন হয়। এই তিন দিনে ডিএসইএক্স কমে ২০০ পয়েন্টের মতো। সিএসইতেও একই ধরনের পতন দেখা যায়।
দেড় বছর পর গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম দফায় ৩৫টি কোম্পানিকে হাতে রেখে বাকিগুলোর শেয়ারের সর্বনিম্ন দর তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সে ঘোষণা অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি ৩৫টি ছাড়া বাকি সব কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর পাইস মুক্ত অবস্থায় লেনদেন শুরু হয়।
২৩ জানুয়ারি থেকে আরও ২৩টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পরও সূচকের উত্থানে আশা সঞ্চার হয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। তবে আবারও টানা পতনে ফের হতাশ হন তারা।
বাজারে এখন ১২টি ছাড়া সব কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়েছে বিএসইসি।
ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বিক্রির চাপে প্রথম দিন বড় দরপতনের পর দুই দিন বাজারে সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীর মধ্যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সবাই ভেবেছিলেন বাজার বোধ হয় এবার ঘুরে দাঁড়াবে।
কিন্তু গত ২৪, ২৫ ও ২৮ জানুয়ারি বাজারে বড় পতন হয়। ফের হতাশ হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। সবশেষ টানা ছয় দিন বাজারে চাঙাভাব দেখা যাওয়ায় আবার আশায় বুক বাঁধছেন তারা।
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা শামীম আহমেদ পুঁজিবাজারের একজন ছোট বিনিয়োগকারী। একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। পুঁজিবাজারে কিছু বিনিয়োগ আছে তার। ফোনেই মতিঝিলের একটি হাউজে লেনদেন করেন।
বাজারের কয়েক দিনের উত্থানে বেশ খুশি শামীম। সোমবার লেনদেন শেষে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ভালোই তো যাচ্ছে বাজার। নির্বাচনের পর থেকেই বাজারে ইতিবাচক ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফ্লোর পাইস উঠে যাওয়ার পর বাজার যেভাবে পড়তে শুরু করেছিল, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে এখন স্বস্তি পাচ্ছি। জানি না আগামী দিনগুলো বাজার কেমন যাবে।”
বাজারের তেজিভাব দেখা দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাজার বিশ্লেষক ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি মোশতাক আহমেদ সাদেক।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ফ্লোর পাইস বসিয়ে বাজারটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তুলে নেওয়ায় এখন স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো হবে।”
তিনি বলেন, “সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে—সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও বাড়ছে। ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ার পর বিক্রির চাপে দু-একদিন বাজারে পতন হয়েছিল; সেটা স্বাভাকি ছিল। এখন সব ভয় কেটে গেছে। এখন বাজার স্বাভাবিক হবে, ভালো হবে।”
সোমবারের বাজার
দেশের প্রধান বাজার ডিএসইতে সোমবার মূল্যসূচকের উত্থানে লেনদেন শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূচকও বাড়তে থাকে, বেড়ে চলে লেনদেন।
শেষ পর্যন্ত ডিএসইএক্স ৪১ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট বাড়ার মধ্য দিয়ে লেনদেন শেষ হয়। সূচক দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩২২ দশমিক ৬০ পয়েন্টে।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে শরীয়াহ সূচক ডিএসইএস ৫ দশমিক ৫৭ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৭৬ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৮ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট বেড়ে ২ হাজার ১৩৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
লেনদেন হয়েছে এক হাজার ১ হাজার ৬৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকার, যা আগের দিনের চেয়ে ৭৫ কোটি টাকা বেশি।
রবিবার এই বাজারে এক হাজার ১ হাজার ৫৮০ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছিল।
সোমবার ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয় ৩৯৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৩২১টির, কমেছে ৪৪টির এবং অপরিবর্তিত ৩০টির দর।
এদিন ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে, যা মোট লেনদেনের ১৫.১ শতাংশ। লেনদেনে এগিয়ে থাকা অন্য খাতের মধ্যে ওষুধ ও রসায়ন ১২.৯ শতাংশ ও সাধারণ বিমা খাতে ১২.৫ শতাংশ।
অন্যদিকে সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৮৭ দশমিক ৪৩ পয়েন্ট বেড়ে ১৮ হাজার ৩২ দশমিক ২৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে। লেনদেন হয়েছে ১৯ কোটি ১৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। রবিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ১৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সোমবার এই বাজারে ২৯২টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৮৭টির, কমেছে ৭২টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৩টির দর।