পুঁজিবাজারের মন্দাভাব কাটছে না। চলমান অনিশ্চয়তা যেন আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
কোম্পানিগুলোর যে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, তাতে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আয়ও হতাশ করেছে বিনিয়োগকারীদের। অন্যদিকে স্বল্পমেয়াদে বাজারে উত্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাজার তলানি গিয়ে ঠেকবে কি না—এ দুশ্চিচিন্তাও করছে বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিক্রির চাপ বাড়ছে বাজারে।
এ পরিস্থিতিতে বাজারের বড় মূলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন বা সংশোধনে মূলসূচকের বড় পতন দেখা দিয়েছে। এতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০০০ পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। প্রায় চার বছরের মধ্যে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি।
সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া বড় মূলধনী কোম্পানি ইফাদ অটো ১৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ দাম হারিয়ে দরপতন হওয়া শীর্ষ ১০টি কোম্পানিগুলোর তালিকায় সবার উপরে অবস্থান করে।
এরপর সাইফ পাওয়ার ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ, কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ ১০ শতাংশ, জেমিনি সি ফুড ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, তৌফিকা ফুড অ্যান্ড লভেলো আইসক্রিমের ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ৯ দশিমিক ৯৩ শতাংশ দাম কমেছে।
গ্রামীণফোন, ইসলামী ব্যাংক, লিন্ডে বিডির লেনদেন বাড়লেও দাম কমেছে।
বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর হারানোয় ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছে।
২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স পড়তে পড়তে ৪ হাজার ৯৩৪ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে নেমে এসেছিল।
শতাংশ হিসাবে রবিবার সূচক পতনের হার ছিল প্রায় ৩ শতাংশ, যা সাড়ে তিন বছরের সর্বোচ্চ পতন। ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকার বাজারে ডিএসইএক্স সূচকটি ১৮১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারিয়ে ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্টে নেমেছিল।
রবিবার ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯৭ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৯৪টির কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৯টিই দর হারিয়েছে। কমপক্ষে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১৫৯টি শেয়ার।
অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক প্রায় ৩০০ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছে। শতাংশ হিসাবে এই সূচক কমেছে ২ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা রবিবার দুপুরে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছে। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময় তারা পুঁজিবাজারে পতন রোধে তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে ১০টি দাবি জানান।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে দরপতন ঘটছে। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পতনের পর পতনে বাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিন্তু শেয়ার কেনার ক্রেতা কম। বিক্রির চাপেই মূলত বাজার পড়ছে।
“বাজারে দরপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের বেশি হারে সুদ দিচ্ছে; অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
“এছাড়া অর্থনীতিতে অস্থিরতা আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। সব মিলিয়ে বাজার বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।”
“অনেক বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব বন্ধ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন,” বলেন শাকিল রিজভী।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান শুরু হয়। মূল্যসূচকের পাশাপাশি লেনদেনও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। টানা চার কর্মদিবসে (৬, ৭, ৮ ও ১১ আগস্ট) প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৮০০ পয়েন্টের মতো বেড়েছিল।
১১ আগস্ট ডিএসইএক্স ৯১ পয়েন্টের বেশি বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে ৬ হাজার ১৫ দশমিক ৯০ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
তবে ১২ ও ১৩ আগস্ট বাজার হোঁচট খায়; এই দুই দিনে ডিএসইএক্স প্রায় ১৫০ পয়েন্টের মতো পড়ে যায়; সূচক নেমে আসে ৫ হাজার ৮৬৭ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে। লেনদেন নেমে আসে হাজার কোটি টাকায়।
এরই মধ্যে ১৩ আগস্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তার নিয়োগের খবরে ১৪ আগস্ট দুই বাজারেই সূচক বাড়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৮৪ দশমিক ৮১ পয়েন্ট। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক সিএএসপিআই বাড়ে ১৩২ দশমিক ৫৫ পয়েন্ট।
মাসরুর রিয়াজের নিয়োগের পরপরই বিতর্ক ওঠার প্রেক্ষাপটে তার নিয়োগ স্থগিত রাখে সরকার। এ খবরে ১৫ আগস্ট দুই বাজারেই সূচকের পতন দেখা যায়। ডিএসইএক্স ৪৮ দশমিক ৯৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯০৩ দশমিক ৮৩ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
এরই মধ্যে ১৬ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান মাসরুর রিয়াজ। পদত্যাগের কারণ জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও দেন মাসরুর।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮ আগস্ট দুই বাজারেই মূলসূচকের বড় পতন হয়েছে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১২৫ দশমিক ১৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৬৩ পয়েন্টে নেমে আসে।
মাসরুর রিয়াজ রাজি না হওয়ায় ১৮ আগস্ট পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে নিয়োগ দেয় সরকার।
কিন্তু পুঁজিবাজারে পতন থামেনি। দু-একদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই সূচক পড়েছে দুই বাজারে। লেনদেনেও খরা চলছে।
রবিবারের বাজার পরিস্থিতি
সপ্তাহের প্রথম দিন রবিবার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৯৬৫ পয়েন্টে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়া সূচক ৩৬ দশমিক ২৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১০৭ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৪৮ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮৩০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
এদিন ডিএসইতে মোট ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ২৯টির। কমেছে ৩৪১টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ২৬টির দর।
৩০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবস গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার লেনদেনের অঙ্ক ছিল ৩০৬ কোটি ১ লাখ টাকা।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে সিএসসিএক্স সূচক ১৬৬ দশমিক ১৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৫৩৯ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭৪ দশমিক ২৯ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার ২৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শরিয়া সূচক ১৭ দশমিক ৫২ পয়েন্ট কমে ৯০৯ পয়েন্টে এবং সিএসই ৩০ সূচক ১২৮ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ৬১০ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
মোট ২০৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে মাত্র ২৬টির। কমেছে ১৭১টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ৭টির দর।
৪ কোটি ২৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
বিনিয়োগকারীদের ১০ দফা
রবিবারের মানবন্ধন কর্মসূচিতে পুঁজিবাজারে পতন রোধে ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নূরুল ইসলাম মানিক ১০ দফা দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলো হচ্ছে- বর্তমান মার্কেট পরিস্থিতির কারণে গেইন-ট্যাক্স দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে (তদন্ত ও অসময়ে কোম্পানিগুলোকে জেড গ্রুপে প্রেরণ ইত্যাদি)। কোম্পানিগুলোর শেয়ারে কোনও ক্যাটাগরি থাকতে পারবে না (যেমন- ‘এ’ ‘বি’ ‘জেড’ ইত্যাদি)। কোম্পানিগুলোকে আয়ের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে।
ব্যাংক, ফাইন্যান্স, ইন্স্যুরেন্স, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও আইসিবিসহ পুঁজিবাজারে তাদের যতোটুকু বিনিয়োগ করার কথা তার পুরোটাই বিনিয়োগ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড মার্কেটে (ইটিএফ) দ্রুত বিনিয়োগ করতে হবে। কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশ অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
বিএসইসির দায়িত্ব অন্তত ১০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোনও কোম্পানি পর পর দুই বছর লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হলে তাহার বোর্ড পুনর্গঠন করতে হবে। ফোর্স সেল বন্ধ করতে হবে।
টানা পতনের প্রতিবাদে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ভবনের সামনে কয়েক দিন আগেও বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা; প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। কিন্তু বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরছে না; পতন থামছেই না।