কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ‘শিক্ষার্থীদের হত্যা, গণগ্রেপ্তার ও রিমান্ডের’ বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষকে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ এর ব্যানারে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকদের সমাবেশ’ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।
বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে শিক্ষকদের এই সমাবেশে যোগ দেন অনেক শিক্ষার্থীও। সমাবেশে অবিলম্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি, সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার এবং কারফিউ প্রত্যাহারের দাবিও জানান শিক্ষকরা।
বেলা ১১টার দিকের এ সমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে শাহবাগে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। তাদের ছাড়িয়ে আনতে সমাবেশ শুরুর আগে মিছিল নিয়ে শাহবাগ যান শিক্ষকরা। সেই শিক্ষকদের নিয়ে মিছিল করতে করতেই অপরাজেয় বাংলার সামনে ফিরে আসেন তারা।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, “৫৩ বছরের যে বাংলাদেশ এই বাংলাদেশকে আমরা কি দেখতে চেয়েছিলাম? আমরা মানবাধিকারের কথা বলি; উন্নয়নের কথা বলি। কিন্তু এই উন্নয়ন আমার মানবিকতাকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি।
“প্রতিনিয়ত আমার মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আজকে আন্দোলনের একটি মোটো ঘোষণা করেছে- রিমেম্বারিং দা হিরোজ। আমরা আমাদের সেই নায়কদের কথা স্মরণ করতে চাই এবং এই নায়কদের জাতীয় স্বীকৃতি আদায় করতে চাই।”
তিনি বলেন, “ওরা আবু সাঈদকে গুলি করেছে; কার্নিশে লুকিয়ে থাকা একজনকে তিন তিনবার গুলি করেছে। আমরা এগুলো একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করছি। এই রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা একটি পজিটিভ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। না হলে এই রক্ত বৃথা যাবে।”
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কোবরাতুল দীপা বলেন, “আমার পরিচয় আমি একজন শিক্ষক। আমার পরিচয় আমি একজন মা। আমি একজন বাংলাদেশি নাগরিক। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের শরীরে যে পরিমাণ রক্ত লেগে আছে, এই বৃষ্টির পানি নতুন করে আর কী-ই বা করবে?
“তারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে। তারা আমাদের সন্তানদের উপর গুলি করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা বোঝেনি ভয় যেমন সংক্রামক, সাহসও তেমনি সংক্রামক।”
তিনি বলেন, “আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নাগরিককে আমি বলতে চাই- এই সাহস বুকে নিয়ে সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু একটি খুনি সরকারের কাছে আমি বিচার চাই না। কারণ সে নিজেই খুনি। এক খুনি আরেক খুনিকে বিচার করতে পারে না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, “চট্টগ্রামে শিক্ষকদের বাসার সামনে বোমা ফেলা হয়েছে। শিক্ষকদেরও নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকার ভুলে গিয়েছে এখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, জনতা বলতে আলাদা কিছু নেই। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, আমরা আমাদের অধিকার আদায় করে নেব।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুতফর রহমান বলেন, “একটি ছেলেকেও জেলে রেখে কোনও শিক্ষা কার্যক্রম করা যাবে না। যেভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাতে একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার।
“দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ নেই, গাজা, ইউক্রেনে পরিণত হয়েছে। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে সরকার, নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে? এই যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণই জয়লাভ করবে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোরশিদা ওয়াহিদ হক বলেন, “এই আন্দোলনের অবশ্যই ইতিবাচক ফলাফল আসবে। এই আন্দোলনে হারানোর কিছু নাই।”
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) শিক্ষক ইমরান আজাদ বলেন, “আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এখন শিক্ষকতা করছি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। এই অবস্থা আমরা কখনও দেখতে চাইনি। আইন আমরা পড়েছি। আজকে আইনের কোনও কিছুই তোয়াক্কা না করে শিশুদের পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।”
সমাবেশে “এটা কোনও স্বাধীন দেশ”-এ প্রশ্ন রেখে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক লাইকা বশির বলেন, “এটা যদি স্বাধীন দেশ হয় তাহলে এমন স্বাধীন দেশ আমি চাই না। একজন মানুষ হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্জন চিনতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি বলে যে দুঃখ ছিল তা আর থাকবে না যদি যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেটাতে আমরা যুক্ত হতে পারি।”
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক রিয়াসাত খান বলেন, “কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। আমার ৮ বছরের মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে- বাবা আমি কি ছাদে যেতে পারব? আমাকে কি গুলি করে মেরে ফেলবে? দেশের বাইরের যে দেড় কোটি প্রবাসী ভাইয়েরা আছেন, তারাসহ সব স্তরের মানুষকে আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “লাশ ও রক্ত আমরা ভুলব না। এই দেশ কাউকে দিয়ে দেই নাই।”
অধ্যাপক সামিনা লুতফা বলেন, “আমাদের শিক্ষকদের বাড়ির সামনে ককটেল নিক্ষেপ করছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশনকে আহ্বান করব- এমন কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসুন। নয় তো আপনাদেরই সরে যেতে হবে।
“প্রতিটি শিক্ষার্থী হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে হবে, প্রতিটি মানুষের রক্তের হিসাব নিতে হবে। এখন এই আন্দোলন জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির আন্দোলন।”