Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

চাকরি ছেড়েই ভোট : একেক নির্বাচনে একেক আইন নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকার নির্বাচন কমিশন ভবন।
ঢাকার নির্বাচন কমিশন ভবন।
[publishpress_authors_box]

ছেলের ছাগলকাণ্ডে বিত্ত-বৈভব নিয়ে আলোচিত সরকারি কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন ২০২৩ সালে উপনির্বাচনে। আর কোনও প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি।

রায়পুরার উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুস সাদেক। ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি মারা যাওয়ায় তিন মাসের মধ্যে ওই উপজেলায় উপনির্বাচন হয়েছিল, যাতে চেয়ারম্যান হন লায়লা। তার ঠিক আগে তাকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক করা হয়।

উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কয়েক মাস আগেও লায়লা ছিলেন সরকারি চাকরিতে। সাদেক যখন মারা যান তখন তিনি ছিলেন ঢাকার তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সরকারি চাকরি ছেড়েই নির্বাচন করে জনপ্রতিনিধি হন তিনি। এবারও নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছেন। তবে সেখানে ভোট স্থগিত রয়েছে। এরমধ্যে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলের ছাগল কেনা নিয়ে তুমুল আলোচনায় তার সম্পদের খবরও আসছে।

লায়লা কানিজ লাকী।

সরকারি চাকরি ছাড়ার মাসখানেকের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে লায়লার আইনগত কোনও বাধা ছিল না। তবে তিনি যদি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইতেন, তাহলে প্রার্থী হতে পারতেন না। কারণ সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধা রয়েছে।

স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না ঘটে, সেজন্য সরকারি চাকরিজীবীদের কেউ অবসর নিয়েই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এই ধারা যুক্ত হয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির সময়।

সংসদ নির্বাচনে এমন বাধা থাকলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কোনও আইনি বাধা নেই; যদিও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সেখানেও ঘটার সুযোগ রয়েছে।

ফলে প্রশ্ন উঠছে, দুই নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুই রকম আইন কতটা যৌক্তিক?

কেউ কেউ মনে করছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই আইন থাকা উচিৎ। আবার কারও কারও রয়েছে ভিন্ন মত।

আইনটি যেভাবে এল

জরুরি অবস্থাকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দেশের নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তাতে এই বিধানটিও যুক্ত হয়।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, কেউ সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবে না, যদি প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের চাকরি হতে পদত্যাগ বা অবসর করার পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়।

এই বিধানটি চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট আবেদনও হয়েছিল। তবে গত বছর তা খারিজ হয়ে যায়। ফলে সরকারি চাকুরেদের চাকরি ছাড়ার পর তিন বছর অপেক্ষার আইন থেকেই যায়।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিএনপি নেতা এস এম আবদুল হালিমের কারণেই এই আইনটি হয়েছে বলে জানান সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হালিম সাহেব যখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন, তখন তার ক্ষমতা খাটিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য উনি এলাকায় প্রকল্প নিয়ে যেতেন। এবিষয়ে তখন পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। সে সময় বিষয়টা সিরিয়াসলি দেখা হয়েছিল। তখন শামছুল হুদা কমিশন আইন করেন।”

সংসদ নির্বাচনের বিধানটি অন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কেন হলো না- সেই প্রশ্নে রফিকুল বলেন, “কেয়ারটেকার সরকারের সময় আইন দ্রুত পরবির্তন হলেও পরে রাজনৈতিক সরকারের সময় তা এত দ্রুত হয় না।”

অন্য নির্বাচনে না থাকা নিয়ে প্রশ্ন

উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচনের মতো এমন বিধান প্রয়োজন বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে চিন্তা ভাবনা থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এটা রাখা হয়নি, আমরা তো এখন সে অবস্থানে নেই। স্থানীয় সরকারে সর্বনিম্ন পর্যায়েও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ গড়ার পাহাড় হিসেবে ব্যবহার করে।”

ফলে সরকারি চাকরিজীবীদের স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে বিধি-নিষেধ থাকা উচিৎ বলে মনে করেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির নির্বাহী প্রধান।

তার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “স্বার্থের দ্বন্দ্বের সীমারেখা টানার জন্য যদি করা হয়, তাহলে এটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।”

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও মনে করেন, সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই আইন থাকা উচিৎ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি মনে করি এটা থাকা উচিৎ।”

সংসদ নির্বাচনের পরপরই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন আয়োজনে নামে ইসি। ফাইল ছবি

ভিন্নমতও আছে

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে আদালতে গিয়েছিলেন কয়েকজন, তবে তাদের যুক্তি ধোপে টেকেনি বলে তা খারিজ হয়ে যায়।

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, সংসদ নির্বাচনের তিন বছরের বিধানটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, “এই আইন থাকুক, এটা আমি মনে করি না। তবে আমরা বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক না। কাজেও গণতান্ত্রিক না।”

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, সংসদ নির্বাচনের বিধি-বিধান উপজেলায় করতে চাইলে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই তা করা উচিৎ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যদি আইনটা করতে হয় তাহলে শুধু উপজেলায় নয়, স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনের ক্ষেত্রেই করতে হবে।”

আর যদি এই বিধান তুলে দিতে হয়, তাহলে আরও জায়গায় পরিবর্তনের পক্ষপাতি ড. তোফায়েল।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের কনটেক্সটে সরকারি চাকরিজীবীরা চাকরিরত অবস্থায় রাজনীতি করে থাকেন। সরকারি চাকরি অবস্থায় যদি রাজনীতি করে, তাহলে সেটাও শৃঙ্খলা পরিপন্থি।

“যদি চাকরিরত অবস্থায় সরকারি দলের সহযোগিতা করেন, তাহলে তাদের শাস্তি দিতে হবে- তাহলেই মাত্র শর্ত সাপেক্ষে এই তিন বছরের বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়া যেতে পারে।’’

যা বলছে নির্বাচন কমিশন

একেক নির্বাচনে একেক বিধানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একেকটা নির্বাচন একেকটা আইন অনুযায়ী হয়ে থাকে। যে নির্বাচন সেই নির্বাচনী আইন অনুযায়ী হয়।”

সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে আইনটি যৌক্তিক, উপজেলার ক্ষেত্রে সেই আইন কেন যৌক্তিক হবে না- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “স্থানীয় সরকারের ভোটগুলো শেষ হলে কমিশন আইন সংস্কারের জন্য বসবে। আরপিওসহ নানা আইন সংস্কারের প্রস্তাব দেবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত