Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

ইসি নিয়োগের আইন নিয়ে প্রশ্ন, বাতিলের দাবি

ss-ec
[publishpress_authors_box]

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যে আইন আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এক আলোচনা সভা থেকে, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

শনিবার ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় আলোচকরা আইনটি বাতিলের দাবি জানান। রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেন তারা।

ইসি সংস্কারে গঠিতব্য কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারও এই সভায় ছিলেন। তিনি বলেন, “এটা কোনও আইনই হয়নি।”

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের বিষয়টিও রয়েছে।

সরকার পতনের পর সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। ২০২২ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ হওয়ার পর তার অধীনে এরা নিয়োগ পেয়েছিলেন।

তাদের বিদায়ের পর ইসি সংস্কারের আলাপ যখন চলছে, তখন নতুন ইসি নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে শনিবার সংলাপের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক হিসাবে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে আসা বদিউল আলম মজুমদার ২০২২ সালের আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “এটা অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য একটা আইন। এই আইনের মাধ্যমে তারা যাকে চান তাকেই নিয়োগ দিতে পারে।”

বক্তব্যে বিদায়ী কমিশনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন পোস্ট অফিস নয়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। যে নির্বাচন গণতন্ত্রকে ব্যাহত করে সেই নির্বাচন সংবিধানসম্মত নয়।”

রাজনৈতিক মতৈক্যর ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া উচিত বলে মত দেন বদিউল আলম। সেই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ছয় থেকে সাতজনের একটি সার্চ কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি। যে কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, বিরোধী দলের একজন, সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধি থাকবে। পাশাপাশি থাকবে একজন করে গণমাধ্যমের ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি।

দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের মত অবশ্য সংখ্যানুপাতিক ভোটের দিকে। তার বিশ্বাস, এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি কমবে।

ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দলগুলো আর জনগণের কথা মনে রাখে না উল্লেখ করে এই সাংবাদিক বলেন, “সেজন্য বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার থাকতে আগামী যে নির্বাচন হবে তার একটি ব্যবস্থা আর তারপর রাজনৈতিক দল আসার পর একটি ব্যবস্থা করতে হবে।”

যদিও একটি নির্বাচন ভালো করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান। দেশের জনগণকে একটি ভালো নির্বাচন দিতে একটি আইন করারও পরামর্শ দেন তিনি। যে আইনে নির্বাচন কমিশন ঠিকভাবে কাজ না করলে তাদের সরানোর ব্যবস্থা থাকবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক মো আব্দুল আলীম তার আলোচনায় বলেন, “যেকোনও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা শুরু হয় নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই। এখানে সার্চ কমিটি কীভাবে স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করবেন তার কোনও রকম বিধিমালা বা গাইডলাইন নেই।”

ঢাকার নির্বাচন কমিশন ভবন।

নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ছাত্র- জনতার প্রতিনিধি থাকা দরকার বলে মনে করেন ডেমোক্রেসি ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তালেয়া রহমান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সব সময় ভোট করলে উপকার পাওয়া যাবে বলেও মন্তব্য তার। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে সবার মতৈক্য থাকা দরকার বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব।

যা বললেন রাজনৈতিক দলের নেতারা

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে আইনটি বাতিলের দাবি তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, “নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু হয় না। সৎ, যোগ্য এবং সাহসী ব্যক্তিদের সার্চ কমিটিতে নিতে হবে।” রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি মতৈক্য আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, ছাত্র সবার কাছ থেকে নাম নিয়ে সার্চ কমিটিসহ নির্বাচন কমিশন গঠন করবো আমরা।”

রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক দোষ- ত্রুটি আছে, তবে তারাই বড় অংশীজন বলে মন্তব্য করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। তাই কীভাবে একটা কমিশন গঠিত হলো, তা যেন পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, সেই দাবি জানান তিনি। রুমিন বলেন, “সরকারী দল না চাইলে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব না। তাহলে ওপেন করে দিই আমরা, রাজনৈতিক দলগুলো নাম দিক। কোন দল কার নাম দিচ্ছে সেগুলো প্রকাশ করা হোক।”

রাষ্ট্র ব্যবস্থার বদল না ঘটলে আলাদা করে নির্বাচন ব্যবস্থা বদলানো যাবে না বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আছে সেটা একটা ফ্যাসিস্ট বন্দোবস্ত দাবি করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে সার্চ কমিটি গঠনে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে মতামত নেওয়ার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিচার বিভাগকে কোনো অবস্থাতে পাবলিক ইন্টারেস্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ঠিক নয় বলে মনে করেন জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ। নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি গঠন কাদের নিয়ে হবে, তার জন্যও আইন প্রণয়ন করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

আলোচনায় সংবিধানের নির্বাচন কমিশন আইনের ৪৮ এর ৩ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা শামীম হায়দার পাটোয়ারী।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করবে কিন্তু নিয়োগ করতে পারবে না কারণ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ লাগবে। যা স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশাল বাধা। এতে বর্তমান সার্চ কমিটি বিদ্যমান দলীয় কাঠামোকেই সমর্থন করবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ বাতিলের দাবি তোলেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরও।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়ার আইন অনুসরণের পক্ষে মত দেন এই সাবেক ছাত্রনেতা। তার মতে, একাধিক দিনেও ভোট করার বিষয় জানতে হবে। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট করা যেতে পারে বলেও মনে করেন নুর।

২০২২ সালের আইন বাতিল করে ভালো নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি চিন্তা করে নতুন আইন বানানোর পরামর্শ দেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএম সভাপতি ববি হাজ্জাজ।

তিন স্তরের সার্চ কমিটি চান সাখাওয়াত

বিভিন্ন মহলের এই আলোচনায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তিন স্তরের সার্চ কমিটি করার প্রস্তাব দেন তিনি।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “প্রথম স্তরের কমিটিতে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, কিছু অফিশিয়াল যেমন মন্ত্রীপরিষদ সচিব থাকতে পারে। সেখান থেকে কিছু সাধারণ নাম আসবে। সেগুলো বাছাই করে দ্বিতীয় স্তরে পাঠানো হবে।

“দ্বিতীয় স্তরে প্রধান ধাকবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। থাকবেন যতগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের প্রধান ও সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তারা নামগুলো বাছাই করবেন। একেকজন কমিশনারের জন্য ৪টা বা ৫টা নাম যাবে তৃতীয় স্তরে।”

কমিটির তৃতীয় স্তর প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংসদ যদি থাকে তাহলে নামগুলো যাবে সংসদের বিজনেস কমিটিতে। এই কমিটিতে যত জন সরকারি দলের লোক থাকবে, ততজন বিরোধী দলের লোক থাকবে।

এরপরের পদক্ষেপ সম্পর্কে সাখাওয়াত বলেন, “এই কমিটি দুটো করে নাম সিলেক্ট করলে, তা যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনি সিলেক্ট করবেন। যদি সবাই মনে করে এসব নাম পাবলিক হওয়া উচিত। তাহলে হতে পারে।”

নির্বাচন কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য বয়স ৪৫ নির্ধারণের পরামর্শও দেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশে যত ইলেকশন কমিশন আছে তার মধ্যে আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এখনও প্রচুর ক্ষমতাশালী বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। সেই সঙ্গে তিনি মনে করেন নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজন। তার মতে, “সরকার থাকা মানেই সরকারি লোক। তাই ভালো নির্বাচন করতে হলে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা থাকতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত