সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের দুইভাই ও বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের সন্তানদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তদন্ত শেষ দিকে রয়েছে।
আগামী মাস জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে তদন্ত কাজ শেষ হতে পারে বলে সোমবার সকাল সন্ধ্যাকে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন আগামী সপ্তাহে তদন্ত কমিটি নিয়ে আরেকটি পর্যালোচনা বৈঠক করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও নির্বাচন কমিশনের সচিব এ তদন্ত কাজ তদারকি করছেন।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের সন্তানদের এনআইডি জালিয়াতি নিয়ে তদন্তে নামে কমিশন। কাছাকাছি সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের দু্ই ভাইয়ের এনআইডি জালিয়াতি নিয়েও তদন্ত শুরু করে কমিশন।
গত ১০ জুন সিইসি জানান, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের দুই ভাই ও বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের সন্তানদের এনআইডি জালিয়াতির তদন্ত শুরু হয়েছে। এজন্য একজন যুগ্মসচিবকে প্রধান করে তিন সদস্যের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
একইদিন দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের দুই ভাইয়ের পাসপোর্ট জালিয়াতি খতিয়ে দেখতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে তারা চিঠি দিয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ (জোসেফ) নিজেদের নামের পাশাপাশি বাবা-মায়ের নামও পরিবর্তন করেছেন।
হারিছ আহমেদ তার নাম পাল্টে হয়েছেন মোহাম্মদ হাসান। তোফায়েল আহমেদ জোসেফ নাম পাল্টে পরিচিতি নিয়েছেন তানভীর আহমেদ তানজীল হিসেবে। অভিযোগ আছে, তাদের এনআইডির তথ্য পরিবর্তনে আজিজ আহমেদ সুপারিশ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মোসলেহউদ্দিনের ছয় সন্তান বাবার নাম পরিবর্তন করে এনআইডি নিয়েছেন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনকে এ তথ্য জানিয়ে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে মোসলেহউদ্দিনের ছয় সন্তানের নাম ও এনআইডির নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান, মাহমুদুল ইসলাম খান, মজিদুল ইসলাম খান, মো. মহিদুল ইসলাম খান, মো. সাজিদুল ইসলাম খান এবং সানাজ খাঁন।
এর মধ্যে শফিকুল, মহিদুল ও সানাজ তাদের পাসপোর্টেও বাবার নাম পরিবর্তন করেছেন। মাহমুদুল ইসলাম তার ড্রাইভিং লাইসেন্সে বাবার নাম পরিবর্তন করেছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারের হত্যা করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য। তখন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উচ্চ আদালত ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০১ সালের জুনে জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
পলাতক খুনিদের মধ্যে আবদুল মাজেদকে ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ এপ্রিল রাতে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পলাতক খুনিদের মধ্যে এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর তিন আসামি খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
‘জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একটা পর্যায়ে আসতে পারে’
দুদক যেসব তথ্য চেয়েছে সেগুলো দিয়েছেন কি না- জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেখানে যা যা করা দরকার তা তো করতেই হবে।”
তিনি জানান, এনআইডি জালিয়াতি তদন্তে গঠিত কমিটির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গতকাল রবিবার কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন রিভিউ করছেন।
আনিছুর রহমান বলেন, “জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও ইসি সচিব সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। আমরা বলেছি যেখানে যা দরকার তাই করতে। প্রয়োজনীয় যেসব তথ্য উপাত্ত দরকার সেগুলো দিয়ে কাজ করতে।”
কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। বেশি সময় নেওয়ার দরকার নাই।”
কমিশন এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহে আবার বৈঠকে বসবে জানান আনিছুর রহমান। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এ মাস তো শেষের পথে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে একটা পর্যায়ে আসতে পারে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব শফিউল আজিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। তারা কাজ করছে। বিষয়টা তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ হলে বিষয়টি বলা যাবে।”
তদন্ত চলাকালে ঈদের ছুটি ছিল জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, “আমরা মনিটর করছি, যাতে জিনিসটা নিউট্রাল হয়। কাজ চলমান আছে।”
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা-১ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান মঈন উদ্দীন খান এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমার কোনও কমেন্ট নাই।”
এসময় তিনি এই প্রতিবেদককে ইসির জনসংযোগ পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে
ইসির জনসংযোগ পরিচালক শরিফুল আলমজানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনও তথ্য নেই।
শরিফুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওই কমিটিতে তো আমি নিজেই নাই। কে আছে? কারা আছে? আমি কিছুই জানি না। আমার কাছে কোনও তথ্য নাই।”
মিথ্যা তথ্যে এনআইডি করলে যে শাস্তি
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন ২০১০ এর ১৪ ধারায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে।
আইনের ১৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, “কমিশনের কোনও কর্মকর্তা বা কর্মচারী অথবা এই আইন দ্বারা বা এর অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত কোনও ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কমিশনের নিকট সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কোনও তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করলে এ অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব সাত বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।”
১৬(২) ধারায় বলা আছে, “কোনও ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত কোনও তথ্য বিকৃত অথবা বিনষ্ট করিলে এ অপরাধের জন্য তিনি অনূর্ধ্ব দুই বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক চল্লিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।”