দিনভর ভোট গ্রহণ শেষে রাতে নির্বাচন ভবনে ফল ঘোষণা শুরু করেছিলেন ইসি সচিব জাহাংগীর আলম। একের পর এক আসনের পূর্ণাঙ্গ ফল পাওয়া যাচ্ছিল তার ঘোষণা থেকে, আসনভিত্তিক ফল নির্বাচন ভবনে বোর্ডে টানিয়েও দেওয়া হচ্ছিল।
কিন্তু সব আসনের ফল ঘোষণা না করেই ভোররাতে নির্বাচন ভবন ছেড়ে যান জাহাংগীর আলম। ২৯৮ আসনের ফল ঘোষণা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে তখনও সাংবাদিকরা সব আসনের ফল পাননি।
সচিব চলে যাওয়ার পর ইসির কর্মকর্তারাও একে একে ভবন ছেড়ে যান। ফলে পূর্ণাঙ্গ ফলের অপেক্ষা শেষ হয়নি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের।
রবিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। বিএনপির বর্জনের মধ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলযোগ, একজনের মৃত্যু এবং আওয়ামী লীগের এক প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভোটগ্রহণ।
সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে এদিন নির্বাচন হয়। এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনে নির্বাচন স্থগিত ছিল।
বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষের পর কেন্দ্রে কেন্দ্রে শুরু হয় গণনা। কেন্দ্রের ফল যোগ করে জেলাগুলোতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল প্রকাশ করেন।
একীভূত সেই ফল কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ফলাফল ও তথ্য ঘোষণা কেন্দ্রে, যেখানে ছিলেন সচিব জাহাংগীর।
সাত ঘণ্টা পর রাত পৌনে ৩টার দিকে জাহাংগীর আলম জানান, ২৯৮টি কেন্দ্রের ফলাফল তিনি ঘোষণা করেছেন।
তবে সাংবাদিকরা সব আসনের ফল না পাওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, “ভবনের সামনে নোটিস বোর্ডে দিয়ে দেওয়া হবে। সেখান থেকে আপনারা (সাংবাদিকরা) তথ্য নিয়ে নেবেন।”
এরপরও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে ইসি সচিব বলেন, সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে জানানো হবে।
সচিব যখন ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণার দাবি করেন। সেই সময়ে কমিশনের ফলাফল কেন্দ্রের ডিজিটাল স্ক্রিন বোর্ডে দেখা যায়, রাজনৈতিক দল অনুযায়ী বেসরকারিভাবে ২১১ আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।
সেখানে নৌকা প্রতীকে ১৫৫ আসনে। স্বতন্ত্র ৪৫ আসনে। জাতীয় পার্টি ৮ আসনে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ১ আসনে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১ আসনে ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১ আসনে জয়ী হয়েছে।
অন্যদিকে ভবনের প্রবেশ ফটকের সামনে কমিশন যে নোটিস বোর্ড দিয়েছে, সেখানে ২৪১ আসনের ফলাফল ঘোষণার শিট পাওয়া যায়।
কমিশনের সচিব জাহাংগীর আলম যখন নির্বাচন ভবন ছাড়ছিলেন, তখন সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের, তিনিও তখন ভবন ছাড়ছিলেন। তিনি বলেন, “সব আসনের ফলাফল বাইরে টানিয়ে দেয়া হবে। আগামীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিং করা হবে।”
আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং কখন করা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে লিফটের ভিতরে দাঁড়িয়ে ইসি সচিব জাহাংগীর আলম বলেন, “ব্রিফিং তো কমিশন করবে। কমিশনাররা বলতে পারবেন।”
কখন করা হতে পারে- জানতে চাইলে তিনি ‘১১ টার পরে’ বলে চলে যান।
ওই সময় নির্বাচনের ফলাফল নিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এ বি এম রিয়াজুল কবীর কাওছার।
পূর্ণাঙ্গ ফল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনিও পাননি। তিনি বলেন, “সচিবকে অফিসিয়ালি বলতে হবে। (নির্বাচন) শাখা তো অফিসিয়ালি বলবে না। আমারে বলছে, কালকে দুপুরে দিবে আনুষ্ঠানিকভাবে।”
২৯৮ কেন্দ্রের ফলাফল সচিব পড়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সব শিট তো এখানেও (নোটিস বোর্ড) লাগে নাই।”
ইসির এই ভূমিকায় কিছুটা অসন্তোষের সুরে কাওসার বলেন, “একটু মিস ম্যানেজমেন্ট আছে। আমার তো এখানে রাইতের অভিজ্ঞতা আছে। একটু মিস ম্যানেজমেন্ট আছে। এটা আমি নিজেও কইতাছি।”
অভিযোগ নিয়ে পৌনে ৩টার দিকে ইসিতে এসেছিলেন ঢাকা-৫ আসনে নৌকার প্রার্থী হারুনর রশীদ মুন্না। তার দাবি, কেন্দ্রে গণনায় তিনি জিতলেও ফলাফল শিটে তাকে পরাজিত দেখানো হয়েছে। তবে তিনি ইসির কোনো কর্মকর্তার দেখা পাননি।
দেশ-বিদেশে ব্যাপক আগ্রহের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটের হার ৪০ শতাংশের মতো ইসির ধারণা। তবে এই ভোটকে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো বলছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সন্ধ্যার পর নির্বাচন ভবনে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। আমি এতটা প্রত্যাশা করিনি।”
নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর বিরোধিতার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, “বিরোধিতা ছিল। দ্যাট ওয়াজ আ বিগ চ্যালেঞ্জ। সেটাকে অতিক্রম করে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে, সহিংসতা তেমন হয়নি, মৃত্যু হয়নি এবং যেখানে কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এদিক থেকে নির্বাচনটা মোটামুটি সুনিয়ন্ত্রিত ছিল।”
ভোটের নিরপেক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “নিরপেক্ষ হয়েছে কি হয়নি, আমি তো স্বচক্ষে এভাবে দেখিনি। এখন ভোটাররা যদি কেউ বলে, অভিযোগ করে, পরে সেটা…
“আমি স্যাটিসফাইড কি স্যাটিসফাইড না, সেটা বলছি না। একটা স্যাটিসফেকশনের কথা বলব, সেটা হচ্ছে সহিংসতা হয়নি। ৪২ হাজার কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। মারামারির যে সহিংসতা, সেটা খুব উল্লেখযোগ্য একটা হয়নি। দ্যাট ইজ আ গুড নিউজ।”
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে কি না- প্রশ্নে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কাজ হচ্ছে নির্বাচন আয়োজন করে ফলাফলটা জনগণকে অবহিত করা। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি হয় নাই, এই মর্মে কোনও সার্টিফিকেট কোনও কর্তব্য নির্বাচন কমিশনের ওপর নেই। এটা পাবলিক বুঝবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না?”