Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫

নওফেলের প্রথা ভাঙার সিদ্ধান্ত কোন চোখে দেখছেন শিক্ষার্থীরা

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল
[publishpress_authors_box]

এসএসসি কিংবা এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় কর্মকর্তা, সাংবাদিকের বহর নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পরিদর্শন একটি স্বাভাবিক ঘটনা বাংলাদেশে। তবে নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল হাঁটছেন এর বিপরীতে।

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কেন্দ্র পরিদর্শনে যাবেন না তিনি।

নিজের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে তার যুক্তি, এই ধরনের পরিদর্শন শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাদের ভোগান্তিতে ফেলে।

পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও যাতে কেন্দ্র পরিদর্শনে না যান, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি এসএসসি, দাখিল, এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষা শুরু হবে। ৩ হাজার ৭০০টি কেন্দ্রে ২৯ হাজার ৭৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থীর তাতে অংশ নেওয়ার কথা।

এর আগের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কিংবা দীপু মনি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় নিয়মিতই রাজধানীতে কেন্দ্র পরিদর্শনে যেতেন। তার আগের মন্ত্রীদেরও যাওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা।

২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মন্ত্রী নাহিদের পরিদর্শনের সময় ১৯টি টেলিভিশন ক্যামেরা, ডজনখানেক আলোকচিত্রী, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের জনা দশেক প্রতিবেদক এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিশাল এক দল দেখা গিয়েছিল।

তখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে েদখা যায়, সেবার পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতরে অন্তত তিন ডজন বাড়তি মানুষের হুড়োহুড়ি, কোলাহল আর ক্যামেরার জন্য তীব্র আলোক প্রক্ষেপণ চলেছিল প্রায় আট মিনিট।

মন্ত্রীর পরিদর্শনের এই রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। দীপু মনির সময়ও তা ছিল। তার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা নওফেল এবারই প্রথম পূর্ণ মন্ত্রী হলেন।

তরুণ এই মন্ত্রীর বছরের পর বছর ধরে চলা রেওয়াজ ভাঙার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, সিদ্ধান্ত খুবই ভালো, কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যেন হাওয়ায় উড়ে না যায়।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শনের দৃশ্য

অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না

ঢাকা রেসিডেনশিয়াল স্কুল থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন সামাউন আফরাজ ফাহিম। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বললেন কেন্দ্রে শিক্ষামন্ত্রী আগমনের অভিজ্ঞতা।

ফাহিম বলেন, “পরীক্ষা হলে ঢোকার সময় থেকে নির্দেশনা শুনতে শুনতে সেটা ফলো করতে করতেই আমার নার্ভাস লাগছিল। মনে হচ্ছিল্ আমি সব পড়া ভুলে যাচ্ছি। হলের মধ্যেও শিক্ষকরা বারবার আমাদের এভাবে বসব- ওভাবে বসবে, এই করবেনা-ওই করবে না, সালাম দিবে- এরকম নানান নির্দেশনা দিয়েই যাচ্ছিলেন।

“আমি বলব, পরীক্ষার হল আসলে শিক্ষামন্ত্রী বা অন্য কারোর পরিদর্শনের জায়গা নয়। নতুন শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই যে তিনি এই বিষয়টি বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনা করেছেন।”

হলিক্রস কলেজ থেকে ২০১০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া লায়লা আঞ্জুমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হঠাৎ হলের মধ্যে এত লোকের উপস্থিতি, আমি বেশ হকচকিয়ে উঠেছিলাম।

“আমার মনে হয়, আমার অন্যান্য সহপাঠীদেরও একই অবস্থা ছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমাদের কী করা উচিৎ, আর কী করা উচিৎ না। আর তার উপরে মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে আছেন। সবমিলিয়ে ইট ওয়াজ আ ডিজাস্টার। আই এম হ্যাপি ফর ২০২৪ ব্যাচ, যারা এইটা ফেইস করা থেকে বেঁচে গেছে।”

বর্তমানে বুয়েটে পড়ছেন সিয়াম। মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি।

তার পরীক্ষার সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সিয়াম প্রথমেই উচ্চারণ করলেন, “ভয়ঙ্কর ছিল সে অভিজ্ঞতা!”

নতুন শিক্ষামন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও সিয়াম বলছেন, মন্ত্রীর এ সিদ্ধান্ত যেন হাওয়ায় উড়ে না যায়।

হাঁপ ছাড়ছেন এবারের পরীক্ষার্থীরা

ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ফাইজা আনাম বন্যা সকাল সন্ধাকে বলেন, “আমি শুনেছি ভালো স্কুলগুলোতেই শিক্ষামন্ত্রী আসেন ভিজিট করতে। আর আমাদের স্কুলে তো অবশ্যই আসেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা যাদের থেকে শুনেছি, তাতে আমি নার্ভাস ছিলাম। হলেও নাকি শিক্ষকরা অনেক স্ট্রিক্ট থাকেন। কিন্তু এই খবর পেয়ে খুব স্বস্তি পাচ্ছি।”

নটরডেম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ডানিয়েল সাংমাও একই স্বস্তির কথা জানান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছুদিন আগেও এই নিয়ে সহপাঠীদের মধ্যে আমরা আলোচনা করছিলাম। সবাই আমাকে বলত, ক্যামেরা সব তোর দিকেই থাকবে, তুই হবি এট্রাক্টিভ পার্ট ইন দ্যা হোল ক্লাস। সেসব ভেবে আসলেও আমি নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু গতকাল শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা শুনে খুবই ভালো ফিল করছি। শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ।”

শিক্ষকরা কী বলছেন

ঢাকার বিএএফ শাহীন স্কুলের গণিতের শিক্ষক হাসানুল বান্না নতুন মন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ক্যামেরাপারসনদের হট্টগোল-এ সমস্ত কিছুতে তাদের (শিক্ষার্থী) যেমন সময় নষ্ট হয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা একটা ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়।”

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শনের দৃশ্য

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, “নতুন শিক্ষামন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

“একইসাথে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, আইন কী বলে? কেন্দ্র পরিদর্শক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির যে কেন্দ্রে প্রবেশের অনুমতি নেই। সেখানে খোদ শিক্ষামন্ত্রী যদি সেই আইনের বাইরে গিয়ে পাবলিসিটি চায় তাহলে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?”

তবে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণায় ভালো-মন্দ দুইই দেখার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মাজহারুল হান্নান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিক্ষামন্ত্রীর কেন্দ্র পরিদর্শনে না যাবার ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি না। যদিও তার কথায় ‍যুক্তি রয়েছে। তবে পরীক্ষা কীভাবে হচ্ছে-সেটাও দেখতে হবে।”

বিশাল বহর নিয়ে মন্ত্রীর পরিদর্শনকে ‘নিন্দনীয়’ বলার পাশাপাশি হান্নান বলেন, “কিন্তু একজন মন্ত্রী- সচিব-বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কেন্দ্র দেখতে যাবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।”

এদিকে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে ‘পরীক্ষার্থীবান্ধব’ মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এটা (হলে মন্ত্রীসহ অন্যদের যাওয়া) তো আগে একটা ডিসট্রাকশন ছিল। শিক্ষার্থীরা এমনকি সংশ্লিষ্টরাও বিরক্ত হতেন।

“অনেক সময় ইনভিজিলিটররা (পরিদর্শক) যে হলে হাঁটেন, তাতেও কিন্তু পরীক্ষার্থীদের সমস্যা হয়। সেখানে মন্ত্রী, সচিবসহ কর্মকর্তারা, মিডিয়ার উপস্থিতি তো নিশ্চয় বড় ধরনের ডিস্ট্রাকশন ছিল।”

নওফেলের সিদ্ধান্তকে ‘প্রয়োজনীয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। এখানে যেন অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ না যান, খুব প্রয়োজন হলে মন্ত্রী যাবেন। কিন্তু সেটাও হতে হবে নীরবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত