Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কলাম

শিক্ষার মান চাইবেন রাজনীতির মান চাইবেন না!

জায়েদুল আহসান পিন্টু। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

ফেইসবুকে শিক্ষকদের নিয়ে গয়রহ মন্তব্যের ঝড় চলছে। হাল আমলে এটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা আমাদের পড়িয়েছেন তাদের কোনও যোগ্যতাই নেই এমনটা বলে যাওয়া! যখন মন্তব্য করছেন তখন হয়ত তিনি শিক্ষককে ছাড়িয়ে গেছেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ছাড়িয়ে গেলে সবচে বেশি খুশি তারাই হয়।

বিচ্যুতি কি শুধু শিক্ষকদের মাঝে ঘটেছে? সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, প্রশাসন কোথায় না? আমলাতন্ত্রে শুনবেন, সিএসপিদের মতো আমলা আর নেই, সাংবাদিকদের কথা বললে শুনবেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, মানিক মিয়াদের মতো সাংবাদিক আর নেই। এমন নেই নেই সব পেশায় শুনবেন।

একটা রাষ্ট্র কী সবক্ষেত্রেই মানের দিক থেকে নিম্নগামী? কোথাও কি কিছু উচ্চগামী নেই? যদি তাই হয়, আমরা যারা মন্তব্য করি তাদের মানটা কোথায়? বিস্তর গবেষণা দরকার। তখন আবার বলবেন শিক্ষকরাতো গবেষণাই করেন না। কেউ কি আমাকে বলবেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়? একটাও না। তাদের কাজ দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা। যেন ভবিষ্যত জীবনটা সুন্দর হয়। গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদারকম হয়। সেই আলোচনা ভিন্ন। শিক্ষকদের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আবার বলবেন র‌্যাংকিংয়ে দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় হাজারেও থাকে না। ওইসব র‌্যংকিংতো পশ্চিমাদের ব্যবসা। যাদের প্রচুর দেশি বিদেশি ছাত্র ভর্তির প্রতিযোগিতা করতে হয়। তবে হ্যাঁ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং খুব খারাপ। তারপরও ভর্তির জন্য একটি আসনের বিপরীতে ৫০টি আবেদন জমা পড়ে। তো এরা র‌্যংকিং দিয়ে কী করবে? হ্যাঁ এটা ঠিক, সারা বিশ্বের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের এগোতে হবে। ওই যে বললাম, শুধু কি শিক্ষায় এগোতে পারবেন? রাজনীতিতে এগোতে হবে না? মূল জায়গাতো রাজনীতি। মাথা ঠিক করেন। বাকিগুলো ঠিক হয়ে যাবে।

সামগ্রিক অর্থে শিক্ষকদের মান কমেছে বলতে দ্বিধা নেই। তবে, এতে রাষ্ট্র আর শিক্ষকদের কার দায় কতটুকু সেটাও নিরুপণ জরুরি। বলা হয় শিক্ষকরা যে হারে লেজুড়বৃত্তি করে, দলীয় রাজনীতি করে, তারা মর্যাদা আদায় করবেন কী করে? কথা সত্য। ঠিক তেমন সাংবাদিকদের দলকানা আর অন্য পেশাজীবীদের দলকানারা কম কিসে? ওই যে বললাম। সর্বত্র একই দশা।

প্রসঙ্গ এসেছে শিক্ষকতার মান নিয়ে। সামগ্রিক অর্থে শিক্ষকদের মান কমেছে বলতে দ্বিধা নেই। তবে, এতে রাষ্ট্র আর শিক্ষকদের কার দায় কতটুকু সেটাও নিরুপণ জরুরি। বলা হয় শিক্ষকরা যে হারে লেজুড়বৃত্তি করে, দলীয় রাজনীতি করে, তারা মর্যাদা আদায় করবেন কী করে? কথা সত্য। ঠিক তেমন সাংবাদিকদের দলকানা আর অন্য পেশাজীবীদের দলকানারা কম কিসে? ওই যে বললাম। সর্বত্র একই দশা।

শিক্ষার্থীরা সাবেক হয়ে গেলে প্রাজ্ঞ হয়, ইচ্ছেমতো মন্তব্য করতেই পারে। কিন্তু শিক্ষকরা পারেন না। শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের কথা বলা মানায় না। মুশকিল হয়েছে এখন কেবল সাবেক শিক্ষার্থীরাই নয়, বর্তমান শিক্ষার্থীরাও যেমন ইচ্ছে মন্তব্য করতে পিছপা হচ্ছে না! আরও দুঃখজনক হচ্ছে কোনও কোনও শিক্ষক আবার এমন কাজে শিক্ষার্থীদের উসকেও দেয়।   

আমি শিক্ষার্থী পড়াই বহু বছরতো হলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দুটোতেই পড়াই। কোনও কোনও শিক্ষার্থী পাই যাদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য শুধু তাদের বাড়ি যাওয়াটা বাদ রাখি। ডেডলাইনতো মানেই না, কুইজ, ক্লাস টেস্টও ঠিকমত দেয় না। ফলাফল প্রকাশের পর তাদের মন খারাপ হয়। তারা টের পায় না এজন্য শিক্ষকের মনটা কত খারাপ হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আবার একধাপ এগিয়ে গ্রেড দেওয়ার পর এসএমস করবে, স্যার আমারতো ‘এ+’ পাওয়ার কথা ছিল! 

সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে পারবো না, তবে এদিক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের যে খাতা আমি দেখি তাতে আমাকে খুবই জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মধ্যে যেতে হয়। প্রশ্ন জমা দেবেন কোর্স টিচাররা। তাদের প্রশ্নগুলো নিয়ে শিক্ষকদের প্যানেল চূড়ান্ত প্রশ্ন তৈরি করবেন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে কোর্স টিচার জানবেনও না প্রশ্নমালায় কী কী ঠাঁই পেয়েছে। এরপর খাতা দেখে নম্বরপত্র জমা দেওয়ার পর আরেকজন শিক্ষক সেই খাতা দেখে আলাদা করে নম্বর দেবেন। তাদের নম্বরের মধ্যে ২০ শতাংশ তারতম্য হলেই আরেকজন শিক্ষক সেই খাতা মূল্যায়ন করবেন।  এরপর গড় করে নম্বর দেওয়া হবে। শিক্ষক জানবেনও না কার খাতা দেখছেন তিনি। খাতায় দাগও দেওয়া যাবে না। চাইলে শিক্ষার্থীরা সেই খাতা আবার নিরীক্ষার দাবি করতে পারেন। মানে যোগ-বিয়োগে ভুল হলে ঠিক করা। কিন্তু খাতা আবার মূল্যায়নের সুযোগ নেই। এত প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়ার পর নতুন করে মূল্যায়ন করতে হলে একই চক্রে আবর্তিত হতে হবে। সেই দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি আর খাতা দেখার প্রক্রিয়াটা খুবই সিস্টেমেটিক।

এক্সটার্নাল পরীক্ষক হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম পড়ালেখার বাইরে আর কোনও কাজে যুক্ত আছো? মানে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। বেশকজন শিক্ষার্থী জানালো তারা ছাত্ররাজনীতি করে। ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত। তো জানতে চাইলাম, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা কবে হয়েছে? জন্মদিনটা বলতে পারলো না। অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে নাই। আসলে তারা ছাত্রলীগও করে না। ওই যে শিক্ষক জানতে চেয়েছেন ক্লাসের পড়ার বাইরে আর কিছু করে কিনা, তাই একটা কিছু বলতে হবে বলেই বললো। এখন ওই শিক্ষার্থী পাস করার পর ফেইসবুকে লিখতেই পারে—ভাইভা’তে আমাকে প্রশ্ন করেছে ছাত্রলীগের জন্মদিন কবে? বলতে পারি নাই বলে গালমন্দ করেছেন শিক্ষক! আর ফেইসবুকের মন্তব্যকারীরা জানতেও চাইবেন না বা জানবেনও না প্রেক্ষাপটটা কী ছিল?

আমার মাষ্টার্সের ভাইভা’র সময় একজন শিক্ষক জিজ্ঞেস করেছিলেন মহানবীর বাবার নাম কী? জবাবটা দিতে পারার পর বিবি খাদিজার বাবার নাম জানতে চাওয়ায় আটকে গিয়েছিলাম। শিক্ষক বললেন আপনার তো দেখি ধর্মজ্ঞান ভালো না। বললাম স্যার ধর্মটর্ম পালন করা হয়ে উঠে না। সাথে সাথে শিক্ষক ধরলেন— ধর্ম বুঝলাম টর্মটা কী? আমতা আমতা করছিলাম…আর শিক্ষক বলেই যাচ্ছেন সারাদিন করিডোরে আড্ডা দিলে হবে! দিন দুনিয়ার খোঁজ রাখতে হবে না! শব্দের ব্যবহার ঠিকমতো করবেন, ধর্মটর্ম আবার কি, বলেন ধর্মকর্ম। ধমক খেয়ে আমার ত্রাহি অবস্থা। হুট করে জিজ্ঞেস করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির নাম বলেন। নামটা মুখে আসছিল না। ওই সময় এগিয়ে এলেন অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান। তিনি একটা পা বারবার নাড়াচ্ছিলেন। সেটা দেখে মনে পড়ে গেল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নামতো লেঘারি, ফারুক লেঘারি। সাখাওয়াত স্যার ক্লু দিয়েছিলেন বলে নামটা মনে পড়লো। এরপরই যোগাযোগের সংজ্ঞা জানতে চাইলেন, কোনও রকমে বললাম। জানতে চাইলেন, এটা কোথায় পড়েছো? বললাম ডি কে বার্লো’র বইতে। তখন বিভাগের সবচে সিনিয়র শিক্ষক ধরলেন ওই বইটা তুমি আসলেই পড়েছো? বলোতো বইটার কভার ডিজাইন কেমন? ততক্ষণে আমি থিতু হয়ে গেছি। বললাম, স্যার জেরক্স কপি পড়েছি, কভারের রং বলতে পারব না। ভাইভা বোর্ডের সবাই হেসে উঠলেন। সাখাওয়াত স্যার এই গল্প আজ ৩০ বছর পরও করেন।

এখন যেমন ভাইভা’য় আমি যাই, ঠিক তেমনি তখন অনার্সের ভাইভা’য় গিয়েছিলেন সংবাদ সম্পাদক কে জি মোস্তফা। তিনি বলেছিলেন তুমিতো সাংবাদিকতা করো। কোন বিট যেন করো। বললাম, ‘নির্মূল কমিটি’। সমন্বয় কমিটির পুরো নাম বলতে বললেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ বলার সাথে সাথেই জাহানারা ইমামের ফোন নম্বর চানতে চাইলেন। প্রতিদিন ফোনে কথা হতো বলে ঠোঁটের আগায় নম্বরটা ছিল। বলতে পারায় সে যাত্রায় উতরে গেলাম। আসলে নবীজীর শশুরের নাম জানতে চাওয়া শিক্ষকও আছেন আবার ক্লু দিয়ে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করার শিক্ষকও আছেন।

উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হলে রাষ্ট্রের দর্শনে পরিবর্তন আনার ধাক্কা দিতে হবে। কিন্তু দলকানাদের সমাজে সেই ধাক্কাটা দেবেন কারা? রাজনীতিটা আগে ঠিক করেন। এদেশে অনেক মেধাবী আছে। দেশটা এগোবেই।

গেল বুধবার ‘বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল’-এর একটি মতবিনিময় সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও ছিলেন। বলে রাখি, উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমসমূহ অ্যাক্রেডিট করতে এই কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা জ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতার ভিত্তি রচনা করে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বহুমুখী সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি টেকসই ও মজবুত করার জন্য উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন আপরিহার্য। এজন্যই সরকার এই কাউন্সিল তৈরি করেছে।

সেখানে ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলছিলেন, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন পাস হয়েছে ২০১৭ সালে আর কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালে, পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে ২০২৪ সালে। তবু ভালো অন্তত আপনারা কাজ শুরু করেছেন। এসময় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বারবার তাদের কিছু আইনী সীমাবদ্ধতার কথা বলছিলেন। উদাহরণ দিচ্ছিলেন, মালয়েশিয়ায় এই রকম কাউন্সিলের ক্ষমতা কত বেশি।

তখন আমি বললাম, ১৯৭৬ সালে মালয়েশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী এসেছিলেন ঢাকায়। সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসা বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী জানালেন, তার দেশে ভালো ও পর্যাপ্ত মেডিকেল কলেজ নেই। অনুরোধ করলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা যদি বাড়ানো যায় তাহলে তার দেশের শিক্ষার্থীরা বেশি হারে এখানে পড়ার সুযোগ পাবে।

উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, আজ ৪৮ বছর পর আমাদের দেশের মন্ত্রীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে অনুরোধ করেন যেন সেদেশের মেডিকেল কলেজের মেঝে পরিষ্কার করার জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কোটা বাড়ানো হয়। তাতে আমাদের দেশের কর্মীরা বেশি করে যেতে পারে। ৪৮ বছরের পার্থক্যটা বোঝা গেল?

শুরুতে যেটা বলছিলাম, উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে হলে রাষ্ট্রের দর্শনে পরিবর্তন আনার ধাক্কা দিতে হবে। কিন্তু দলকানাদের সমাজে সেই ধাক্কাটা দেবেন কারা? রাজনীতিটা আগে ঠিক করেন। এদেশে অনেক মেধাবী আছে। দেশটা এগোবেই।

লেখক: সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষক। সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত