ঘটনাটা ১৯৮৮ সালের, বন্যার বছরের। বেশ কষ্টে ছিল মানুষ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ কর্মকাণ্ড চালু করা হয়। আমি তখন জাতিসংঘ শিশু তহবিলে কাজ করি। আমাকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো হয় সরেজমিনে অবস্থা দেখতে।
গাড়িতে করে উন্নত কিসিমের রাস্তায় নির্বিবাদে দ্রুত চলাফেরা। যেখানে যেখানে কাজ হচ্ছে সেখানে গিয়ে দেখা, যাচাই করা, কথা বলা, রিপোর্ট তৈরি করা, যা হয় আর কি। অনেক রকম মানুষের সাথে দেখা হতো। আলাপ হতো। একেবারে দুস্থ থেকে অবস্থাপন্ন।
তখনও একাত্তরের স্মৃতি মিলিয়ে যায়নি। জিজ্ঞাসা করতাম, শুনতাম, আলাপ করতাম। রাতে ডেরা বাঁধতাম কাছের জেলা শহরে।
২.
আমার ট্রিপের শেষের দিকে রংপুর যাই। মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত, বোঝা যায়। ভৌগোলিক কারণেও সমস্যা আছে এলাকাটার। বাণিজ্য সুযোগ কম। বর্ডার এলাকার কারণে ইন্ডিয়ায় গিয়ে কামলা দেয় কিছু মানুষ।
সারাদিন কাজ সেরে বিকেলের দিকে শহরে প্রবেশ করি। থাকার জন্য সরকারি এক গেস্ট হাউসে ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রেট, থাকতে পারলেই হলো। পুরানো দিনের লাল বাড়ি। এই সরকারি বাড়িগুলো সবই একই রকম দেখতে সারা দেশে। এমনকি ইন্ডিয়া, পাকিস্তানেও দেখতাম এই একই ডিজাইনের বাড়ি। মানে ব্রিটিশ আমলে যে ব্যাটা ইংরেজ এসব নকশা বানাতো তার পরিধি গোটা ভূ-ভারত জুড়ে। ঘর দেখিয়ে দিয়ে চা আনতে গেল পিয়ন গোছের লোকটা। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
৩.
লোকটা চা দিতে এলে আমি ওকে বসতে বললাম। দিনশেষে মানুষের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে আমার। ওরাও পছন্দ করে একটু আধটু আলাপ করতে ‘সায়েবদের’ সাথে। সরকারি আমলারা তো ওদের সাথে কথা বলে না, আমরা আমলা নই, তাই একটু মন খুলে ভালোমন্দ শোনা যায়। লোকটা মেঝেতে বসল পায়ের ওপর।
আমি এ কথা সে কথার পর, যে প্রশ্ন সবাইকে করি সেটাই করলাম— ‘‘যুদ্ধের সময় কই আসিলেন?’’
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর বলে— ‘‘দেশে, গেরামে।’’
‘‘এখান থেকে কত দূর?’’
‘‘অনেকদূর স্যার, এতো দূর যে, দেশে যাই না আর।’’
‘‘ক্যান?’’
লোকটা তাকিয়ে থাকে। আমি কিছু বলি না। আমি জানি, যুদ্ধ কাকে বলে। যুদ্ধের স্মৃতির দাপট কত।
৪.
একাত্তরের যুদ্ধের কয়েকটি পর্ব আছে— তবে মোটা দাগে তিনটা। প্রথম পর্ব: প্রতিরোধ যুদ্ধ, যেটা শুরু হয় ২৫ মার্চ রাত থেকে এবং চলে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত বা পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ দখল করা পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব: এটা শুরু হয় ট্রেনিং নেওয়া যোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে। এটা চলে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। এরপর তৃতীয় ও শেষ পর্ব: এই পর্ব হচ্ছে সম্মুখ-যুদ্ধ, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ, যা শেষ হয় ১৬ই ডিসেম্বর। এই তিন পর্বের যুদ্ধ আলাদা। যুদ্ধে মানুষের আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতার চিত্র পাওয়া যায়, মানুষের কষ্টের আলাদা আলাদা চেহারা। এমনকি ধর্ষণের প্রকৃতিও ভিন্ন।
৫.
প্রতিরোধ পর্বে শারীরিকভাবে জোর করে ধর্ষণের খবর বেশি পাওয়া যায়। পাকিস্তানি আর্মির প্রস্তুতি ছিল না এই যুদ্ধের জন্য। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে রসদের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। তাই রসদ সংগহে তারা গ্রামে গ্রামে হানা দেয়। খাওয়া লুট করেছে, মেয়ে উঠিয়েছে। এই কারণে গ্রাম ক্ষেপে গেল। আর গ্রামের বিরুদ্ধে বা কোটি কোটি মানুষের সাথে লড়া প্রায় অসম্ভব যে কারও জন্য।
দ্বিতীয় পর্বে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে থাকত। তখন আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে মেয়ে চাইত, খবর দিত রাজাকার আর শান্তি কমিটির মাধ্যমে। বলত মেয়ে দাও, নাহয় আক্রমণ করে যাকে ইচ্ছা মেয়েদের উঠিয়ে নেব। জোর করে উঠিয়ে নেওয়াও হতো। এই কারণে কিছু ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্বে, গ্রামবাসীরাই বাধ্য হতো নিজেরা বাছাই করে মেয়েদের তুলে দিতে আর্মির হাতে।
এটি ধর্ষণের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস্তবতা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে এটা। গ্রামের বাকি মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটা করতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যাদের তুলে দেওয়া হতো তারা প্রায় সব ক্ষেত্রেই গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র ঘরের মানুষ, অসহায় মানুষ।
৬.
একসময় লোকটা কথা বলা শুরু করে আবার। একেবারে কামলা শ্রেণির মানুষ। তখন তার মেয়ের বয়স বড়জোর ১৩/১৪ হবে। মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েটা। তাকে তুলে দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ। ওর পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। মেয়েটাকে নিয়ে চলে যায় রাজাকাররা। কোনও আপত্তি কেউ করেনি, নিজেদের মেয়ের কথা ভেবে। কয়েকদিন পর মেয়েটা ফেরত আসে। জানার উপায় নাই কী গেছে তার ওপর দিয়ে। তবে অনেক চুপচাপ হয়ে যায় মেয়েটা।
এর দিন সাতেক পর গোটা পরিবারটা গ্রাম ত্যাগ করে রংপুর শহরে চলে আসে। লোকটা কুলির কাজ করে প্রথমে, তারপর এক চায়ের দোকান। সেখান থেকে যুদ্ধের পর এই রেস্ট হাউসে পিয়ন।
লোকটা মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে নিঃশব্দে। আমিও চুপ করে বসে থাকি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।
৭.
পরের দিন বেশ সকালেই আমি রওনা হই। রংপুর এক রাতের বিষয় ছিল।
লোকটার সাথে সকালে ঘরে আর দেখা হয়নি। গাড়িটা যখন গেটের কাছে আসে, দেখি লোকটা একটি ৩০/৩২ বছরের মেয়েকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে গাড়ি থামাতে বলে হাত তুলে। গাড়ি থামালে, মেয়েটাকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘‘স্যার নিয়ে যান, নিয়ে যান ওকে স্যার …।’’
আমি হতবুদ্ধি হয়ে কোনও উত্তর দিতে পারিনি। ড্রাইভার বিষয়টা বুঝতে পেরে গাড়ি স্টার্ট দেয়। লোকটা পিছনে পিছনে আসতে থাকে আর ডাকতে থাকে— ‘‘স্যার নিয়ে যান, ওর কেউ নাই, নিয়ে যান।’’
‘‘আল্লার কসম লাগে, বাচ্চাটারে নিয়া যান…’’
মেয়েটার মুখে কোনও অভিব্যক্তি নাই, এমনি দাঁড়ানো; আর বাবাটা ডাকছে কেবলি— ‘‘আল্লার ওয়াস্তে নিয়ে যান স্যার, নিয়ে যান।’’
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক
ইমেইল: [email protected]