Beta
সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫

ভোটের পরে অভিযোগ কমেনি, মামলা কেন কমছে

ঢাকার নির্বাচন কমিশন ভবন।
ঢাকার নির্বাচন কমিশন ভবন।
[publishpress_authors_box]

সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তখনকার ঢাকা-১০ (রমনা-তেজগাঁও) আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে হেরে গিয়েছিলেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের বর্তমান মহাসচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল মান্নান। বিদায়ী সংসদ সদস্য মান্নানকে হারিয়ে সেবার জিতে যান আওয়ামী লীগের ডা. এইচ বি এম ইকবাল।

১৯৯৬ সালের সেই নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মান্নান অভিযোগ তোলেন, কারচুপি করে তাকে হারানো হয়েছে। নির্বাচনী আপিল ট্রাইবুনালে মামলাও ঠুকে দেন তিনি।

সে মামলায় তিনি জিতেও গিয়েছিলেন বলে জানান মান্নানের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।

তবে নির্বাচনী আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যান ইকবাল। ততদিনে সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদের তিন বছর গড়িয়ে গেছে।

মান্নান নির্বাচনী ট্রাইবুনালে জিতলেও উচ্চ আদালতে আর আইনি লড়াই চালাননি বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান ওমর ফারুক।

আব্দুল মান্নান

কেন করেননি- জানতে চাইলে মান্নান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৯৯৮ কিংবা ১৯৯৯ সালের দিকে মামলায় জিতলাম। পরে ইকবাল আপিল করলেন হাইকোর্টে।

“তখন দেখি মোটে ১ বছর সময় আছে। হাতে সময় না থাকার কারণে আর সেই মামলা নিয়ে লড়ি নাই।”

১৯৯১ সালের এমপি মান্নান ২০০১ সালে ওই আসনে আবার ইকবালকে হারিয়েই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে বিএনপি ছাড়ার পর থেকে বিকল্প ধারায় রয়েছেন তিনি।

২০০০ সালের আগে মান্নানের মতো অনেকে ভোটে হেরে মামলা করলেও দিন দিন এমন মামলার সংখ্যা কমে আসছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দুই-একটি মামলা হয়, এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরও মামলার সংখ্যা হাতেগোনা। যদিও নির্বাচনের ফল নিয়ে পরাজিত প্রার্থীদের অভিযোগ আগের মতোই আছে।

অতীতের আলোচিত সব ঘটনা

২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ভোটে হেরে নির্বাচনী আপিল ট্রাইবুনালে মামলা করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা সুধাংশু শেখর হালদার।

২০০৬ সালে নির্বাচনী আদালতের রায়ে ওই আসনে সাঈদীর জয় বাতিল হয়ে যায়। তবে ততদিনে সেই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সাঈদীকে সংসদ সদস্যপদ হারাতে হয়নি। যুদ্ধাপরাধে আমৃত্যু সাজা ভোগ করার মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সাঈদী গত বছর মারা যান।

নবম সংসদে সদস্য পদ বাতিল হওয়ার নজির দেখা গেছে। তবে তা ভোটে কারচুপির জন্য নয়।

সুধাংশু শেখর হালদার

২০০৮ সালের ওই নির্বাচনে ভোলা-৩ আসনে বিএনপি নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিনকে হারিয়ে দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জসিম উদ্দিন। কিন্তু সামরিক বাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরের পাঁচ বছর পার হওয়ার আগেই জসিম নির্বাচন করেছেন- এ অভিযোগে হাফিজ আদালতে মামলা করেন। হাইকোর্ট পরে জসিমউদ্দিনের সংসদ সদস্য পদ অবৈধ ঘোষণা করে। এরপর ইসি সেখানে উপনির্বাচন আয়োজন করে।

নবম সংসদেই টাঙ্গাইল-৫ আসনে মহাজোটের প্রার্থী আবুল কাশেম লাঙ্গল প্রতীকে বিজয়ী হন। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মাহমুদুল হাসান। তবে কাশেম ঋণখেলাপি বলে তার প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা নেই দাবি করে মাহমুদুল হাইকোর্টে আবেদন করেন।

তখন কাশেমের প্রার্থিতা বাতিল করে টাঙ্গাইল-৫ আসনে বিএনপি প্রার্থী মাহমুদুল হাসানকে বিজয়ী ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। পরে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

ওই সংসদে চাঁদপুর-১ (কচুয়া) আসনে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির এহছানুল হক মিলন। দুর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ডের সাজা থাকায় ২০০৮ সালের সেই ভোটের আগে আলমগীরের প্রার্থিতা বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে ভোট করে জয়ী হন তিনি।

কিন্তু এরপর ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট মহীউদ্দীন আলমগীরের মনোনয়নপত্র এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াকে বাতিল ঘোষণা করে। তবে পরে উচ্চ আদালত ওই দুর্নীতি মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিলে তার সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকে।

মামলা যাচ্ছে হারিয়ে

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কামারুল আরেফিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন সেখানে।

ওই আসনে ২০০৮ সাল থেকে তিনটি নির্বাচনে জয়ী ইনু এবার হারের পর ভোটে অনিয়মের নানা অভিযোগ তোলেন। সংবাদ সম্মেলনও করেন তিনি।  

তবে এসব অভিযোগ নিয়ে নির্বাচনী আপিল ট্রাইবুনালে কোনও মামলা তিনি করেননি।

হাসানুল হক ইনু

কেন করেননি- জানতে চাইলে ইনু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মামলা করার জন্য যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা দরকার, তা সংগ্রহ করা হয়নি।”

সাবেক মন্ত্রী ইনু মামলা না করলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৮টি সংসদীয় আসনে নির্বাচনী মামলা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ঢাকা-৫, টাঙ্গাইল-৬, জামালপুর-৪, কিশোরগঞ্জ-৫, ময়মনসিংহ-৮, ময়মনসিংহ-১০, ময়মনসিংহ-১১, দিনাজপুর-৫, দিনাজপুর-৬, নাটোর-১, ঝিনাইদহ-১, পাবনা-১, চট্টগ্রাম-২, চট্টগ্রাম-১৬ ও যশোর-৫ আসন।

গত মে মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও হলফনামায় তথ্য গোপনের মামলায় জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের সংসদ সদস্যকে জবাব দাখিলের জন্য চার সপ্তাহের সময় দেয় হাইকোর্ট।

জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান হেলাল। আগামী ১২ জুন মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।

মামলা কেন কমছে

পরাজিত প্রার্থী অর্থবল ও মনোবল হারিয়ে আর আদালতে যেতে চান না বলে মামলার সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। তাছাড়া এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে হতে সংসদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়াটাও বড় কারণ হিসাবে দেখান তিনি।

রফিকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্টে, তারপর আবার আপিল। পিরোজপুরের সুধাংশু শেখর হালদার নির্বাচনী মামলায় যখন রায় পান, তখন সেই সংসদের কার্যক্রম শেষ হয়ে নতুন সংসদের কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছিল।”

নির্বাচনী আইনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নির্বাচনী ট্রাইবুনালে ৬ মাসের মধ্যে রায় দিতে হবে বলা আছে। এর বাইরে যেসব আদালত আছে, তার বিষয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতার কোনও আইন নাই।

“আদালতে হস্তক্ষেপ করা যায় না। তাই প্রার্থীদের অনাগ্রহ থাকে। হেরে যাওয়া প্রার্থীদের অর্থবল ও মনোবল হারিয়ে যায়।”

আবার ভোটে হারা প্রার্থীর জন্য সাক্ষী যোগাড় করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।

রফিকুল ইসলাম

তিনি বলেন, “পরাজিত প্রার্থী যদি সত্য বলেও থাকে, তাকে প্রমাণ দিতে হয় সাক্ষীর। যে সাক্ষ্য দেবে, তাকে বর্তমান এমপির বিপরীতে যেতে হয়। অনেকেই বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চায় না। কারণ তাকে তো এমপির বিভিন্ন সুপারিশ নিতে হয়।”

রফিকুল বলেন, স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকে মামলায় রায় পেয়ে শপথ নিতে পারলেও অন্য নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না।

যেহেতু মামলাগুলো আদালতে হয়, তাই স্থানীয় সরকারের সব মামলার তথ্য নির্বাচন কমিশনও পায় না জানিয়ে তিনি বলেন, তবে সংসদ নির্বাচনের মামলাগুলোর তথ্য থাকে।

সংসদ নির্বাচনের মামলাগুলোরও তথ্য পাওয়া যায়নি জানালে তিনি বলেন, “একাদশ ভোট নির্বাচনী মামলাগুলো আদালত আমলে নেয়নি। দু-একটি মামলা হয়েছিল। তবে পরে তার কী হয়েছে, তা আমি বলতে পারব না।”

যেভাবে করতে হয় নির্বাচনী মামলা

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী নির্বাচনী বিরোধ সম্পর্কে ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচনের প্রার্থী কর্তৃক নির্বাচনী দরখাস্ত দাখিল ব্যতীত কোনও নির্বাচন সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না।

অর্থাৎ শুধু ভোটে লড়ে পরাজিত হওয়া প্রার্থী এ প্রশ্ন তুলতে পারবেন। তবে সে জন্য তাকে নির্ধারিত সময়ে আবেদন হাইকোর্টে জমা দিতে হবে।

ফলের গেজেট হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে এ মামলা করার বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের গেজেট হওয়ার পরে থেকে মূলত দিন গণনা শুরু হবে।

নির্বাচনী আবেদন দাখিলের সময় হাইকোর্ট বিভাগের বিধি অনুযায়ী দরখাস্তের ব্যয়ের জামানত হিসাবে ৫ হাজার টাকা হাইকোর্ট বিভাগে জমা দিতে হয়।

নির্বাচনী দরখাস্তে অভিযোগগুলোর প্রমাণসহ পূর্ণ বর্ণনা দিতে হয়।

আবেদনে নির্বাচিত প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পাশাপাশি পুরো নির্বাচন বাতিলও চাওয়া যায়।

প্রত্যেক নির্বাচনী মামলা যতদূর সম্ভব দেওয়ানি কার্যবিধি ,১৯০৮ এর অধীনে দেওয়ানি মামলা বিচারের পদ্ধতি অনুসারে বিচার করা হয়।

কোনও নির্বাচনী আবেদনের বিচার মুলতবি রাখিবে না যদি না বিচারের স্বার্থে মুলতবির প্রয়োজন হয়। হাইাকোর্ট বিভাগ সম্ভাব্য দ্রুত সময়ের মধ্যেই শুনানি করবেন। দরখাস্ত দাখিল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করবেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত