‘দশটা নির্বাচনী ইশতেহার পড়ার সময় কোথায় জনগণের’? অথবা ‘যত টাকা লাগে লাগুক এই ইলেকশনে আমাকে জিততেই হবে’।
রুপালি পর্দার এসব সংলাপ জানান দিচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পর্দার অন্তরালের রাজনীতি কতো ম্যারপ্যাঁচের!
এসব সিনেমার খল চরিত্রগুলো শুধু বিত্তশালীই নয়, রাজনীতিক। দুইয়ে মিলে ক্ষমতাবান। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব খল চরিত্রের যেকোনও মূল্যে জয় পাওয়ার লিপ্সা বড় পর্দায় এসেছে অনেকবারই।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘ত্রাস’
রাজনৈতিক গল্পে সিনেমা নির্মাণে কাজী হায়াতকে এগিয়ে রাখতেই হবে। কাজী হায়াৎ আবার এমন প্লটে চিত্রনায়ক মান্নাতেই ভরসা রাখতেন। এই জুটির একাধারে ব্যবসা সফল অনেক সিনেমার মধ্যে অন্যতম সিনেমা ‘ত্রাস’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯২ সালে। মান্নার সাথে বড় পর্দা ভাগ করে নিয়েছিলেন সুচরিতা, বুলবুল আহমেদ, কবিতা, রাজীব।
কলেজের নির্বাচনে জেতা কতটা জরুরি বোঝাতে রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বলেন, “চেয়ারম্যান, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগেই যদি আমরা কলেজ দখল করতে না পারি তাহলে গতবারের মত এবারেও ওই জেলার তিনটি সিট -ই হারাবো।”
মহাসচিব আবার অস্ত্রবাজ গুণ্ডা পোষেন। তাদের টাকা দেন স্টেনগান কেনার। সৎ প্রিন্সিপালকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে গিয়ে মহাসচিব বলেছিল, “আগামী ইলেকশনের আগে কলেজ দখলে না আসলে ইলেকশনে একটা সিটও পাবো না। ওই প্রিন্সিপাল আমাদের বিরোধী দল।”
ভোটের আগে টাকা ছড়াছড়ি করার বিষয়টিও এসেছে সিনেমায়। কলেজের শূন্য তহবিলে এক লাখ টাকা দান করেন অস্ত্রবাজ লালনপালনকারী নেতা। জাতীয় নির্বাচনে যদি সবাই ভোট দিয়ে তাকে জয়ী করে তবে কলেজটিকে সরকারি কলেজ বানিয়ে দেবেন- এমন ওয়াদা শিক্ষার্থীদের সামনে এক সভায় করেন তিনি।
এসবের মধ্যে নিজ এলাকা থেকে ‘এমপি হওয়ার বড় ইচ্ছা’ জানান দেন চেয়ারম্যান। তা শুনে নেতা শুরুতেই বলেন, “টাকা-পয়সা কেমন আছে? … সংসদ ইলেকশন অনেক টাকা লাগে। ” চেয়ারম্যানের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন নেতা; নিজের দল থেকে ওই এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেন। সিনেমার কাহিনী ও এসব সংলাপ লেখা হয়েছিল কাজী হায়াতের হাতেই।
’দেশ দরদী’ নেতার খোঁজে
নায়ক মান্নার আরও একটি রাজনৈতিক সিনেমা দেশ দরদী। সিনেমায় আরও ছিলেন ভারতের ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রাজীব, দিলদার। শরীফ উদ্দীন খান দীপুর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা ব্যবসা সফল সিনেমার তালিকায় নাম লেখায়।
পুলিশের পোশাক ছেড়ে রাজনীতিকদের মতো পাঞ্জাবি-চাদর ধরেন আকবর। সাগরেদদের কাছে নিজেকে ‘জনদরদী নেতা’ পরিচয় দিয়ে আকবর ঘোষণা করেন, “এবার আমি এমপি ইলেকশনে দাঁড়াবো। … কোনো পার্টি থেকেই না। আমি স্বতন্ত্র ভাবে ইলেকশন করব। ” সাগরেদদের নির্দেশ দেন, “পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় গ্রামে-গঞ্জে লোক ঠিক করতে থাকো। যত টাকা লাগে লাগুক। এই ইলেকশনে আমাকে জিততেই হবে। ”
আকবর লোকজন ঠিক করে সভার আয়োজন করে মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে। আকবর সভায় ভোট চেয়ে বলেন, “এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাকে নির্বাচিত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।” সভায় পাহারারত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাবিলদার কদম আলী তখন আপন মনে বলে ওঠেন, “আবার কী সুযোগ চা? প্রধানমন্ত্রী হইতে চায় না তো?”
ভোটের দিনের দৃশ্য সিনেমায় না থাকলেও পরের দৃশ্যে বোঝা যায় আকবর এমপি হয়েছেন। আর এমপি তিনি সব অবৈধ ব্যবসায়ীদের ডেকে নির্বাচনে জিতে আসতে সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান; এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের আবারও পুরোদমে ব্যবসা শুরু করার নির্দেশ দেন। ঘটনা এভাবে এগোতে থাকে। সিনেমার শেষে অবশ্য দুষ্টু নেতা বধ হয় রাজার হাতে।
ভোটের ‘রাজনীতি’
পরিচালক বুলবুল বিশ্বাসের অভিষেক সিনেমা রাজনীতি মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। চিত্রনাট্য তারই লেখা। সংলাপ লিখেছেন দেলোয়ার হোসেন দিল। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, সাদেক বাচ্চু, অমিত হাসান, আলীরাজ অভিনীত সিনেমাটি বেশ কয়েকটি পুরস্কার বাগিয়ে নিয়েছিল।
সিনেমার শুরুতেই বৃষ্টি ভেজা রাতে দুটো খুনের পর বড় ভাইকে নাজিমুদ্দিন বলে, “ইলেকশন সামনে, এই টাইমে জমিরের মত একটা বিশ্বস্ত লোক মাইরা ভোট কমাইলে কিন্তু রাজনীতি চলবো?”
উত্তরে বড় ভাই বলেন, “একটা ভোট কমাইলে যদি আমার এক লাখ ভোট আহে তাইলে ওইরকম দশটা ভোটের বলি দিতে আমার হাত কাঁপবো না।”
এদিকে অন্য রাজনৈতিক দলের লোকের সাথে মারামারি হয়ে যায় অয়ন ও তার ভাইয়ের। ভোটের আগে এসব ঝামেলা চান না জানিয়ে দুই ছেলের বাবা বলেন, “সামনে আমার ইলেকশন”।
জনতা পার্টির দলীয় সভায় জব্বার ঘোষণা দেন, “সামনে নির্বাচনের জন্য আমরা ১১০টা ইশতেহার তৈরি করেছি এবং মাঠ পর্যায়ে কিছু নতুন নতুন ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম তৈরি করেছি যাতে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের কছিাকছি যাওয়া যায়।” বিদেশ থেকে আইটিতে পড়ালেখা করে আসা অয়ন বলে ডিজিটাল বাংলাদেশে ঘরে থেকেও জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। অয়ন আরও বলেন, “এবার থার্টি পারসেন্ট নতুন ভোটার। ইয়ং জেনারেশন।”
ওদিকে দেশবন্ধু পার্টির দলীয় সভা চলছে। নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার না কি দলীয় সরকারের অধীনে হবে এসব ভেবে ‘মূল্যবান সময় নষ্ট করার সময়’ তাদের হাতে নেই। ঘটনা চক্রে অয়নের ভাই যোগ দেয় দেশবন্ধু দলে। দলের প্রধান তাকে বলেন, ”সামনের নির্বাচনে সাত নম্বর আসন থেইকা তুমি আমার দলের হইয়া নির্বাচন করবা।” পরের দিকে রাজনীতি আর প্রেম মিলিয়ে সিনেমার গল্প আরও জটিল হতে থাকে।
নির্বাচনের ছক নিয়ে ’নায়ক’
মান্না,পূর্ণিমা, ডিপজল, সাদেক বাচ্চু, নাসির খানের সিনেমা নায়ক মুক্তি পায় ২০০২ সালে। এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন ইস্পাহানী আরিফ জাহান।
ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী মাকুশাহর বাবা দেশে ফিরতে পারছে না। প্রস্তাব আসে, মাকুশাহর বাবা পিনু শাহকে ফিরিয়ে আনা হবে যদি আগামী নির্বাচনে গণ পার্টিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
গণ পার্টিকে নির্বাচনে জেতানোর নীল নকশা সাথে করে দেশে ফেরে পিনু শাহ। নেতাদের সাথে জরুরি বৈঠকে বসে পিনু শাহ বলে, “দেশের ইলেকশন খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, এই ইলেকশনে যে কোনো মূল্যে সোলেমান বেপারির দলকে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসাতে হবে।”
প্রেম, অনেক মারামারি, খুনোখুনি নিয়ে সিনেমার গল্প এগিয়ে যায়। ভোটের দিন সিনেমায় আসেনি। তবে অবধারিত ভাবে মন্দ লোকের পরাজয় ঘটে নায়কের হাতে।
ভোটের অর্থ শেখালো ’বিশ্বনেত্রী – লিডার অফ ইউনিভার্স’
মুক্তির আলো পড়েনি বলে দর্শক এখনও নায়িকা বর্ষার ‘নেত্রী: দ্য লিডার’ রূপ দেখা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। তবে ১৯৯৬ সালে বিশ্বনেত্রী – লিডার অফ ইউনিভার্স রূপে পর্দায় এসেছিলেন শাবানা। সাথে ছিলেন জসিম, হুমায়ুন ফরিদী, আমিন খান, শাহনাজ, দিলদার, কাবিলা, নাদের চৌধুরী।
দেশি সিনেমার পরিচালক ও প্রযোজক বাদল খন্দকার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে। যদিও পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। তার পরিচালিত ‘বিশ্বনেত্রী– লিডার অফ ইউনিভার্স’ সিনেমায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চালবাজি চাঁছাছোলা ভাবেই এসেছে।
সিনেমার একটি চরিত্র ভিসিআর বা ভোলা চৌধুরী রাজা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতপা-ঘাড় টিপে দিত। রাজাকার থেকে কার কেটে নামের সাথে রাজা বসানো ভিসিআর ব্রত ‘ইলেকশনে এমপি হওয়ার’। কলেজের প্রিন্সিপাল, পুলিশের লোক ভিসিআরকে সমর্থন দেয়। পোষ্য লোকেরা বলে, ইলেকশনে জিতলে সাত রাস্তার মোড়ে ভিসিআরের বিরাট মূর্তি বানিয়ে দেবে।
ভোটের নমিনেশন কাগজ জমা দিতে বাহিনী নিয়ে ট্রাকে রওনা করে ভিসিআর। নির্বাচন কমিশন দপ্তরের বাইরে তার সমর্থনে স্লোগান চলে, “ভিসিআর ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র; ভিসিআর ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে।” ভেতরে চেয়ারে বসে ভিসিআর জানতে চান, “কি অফিসার, আর কেউ জমা দিয়েছে নাকি?” মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ পাঁচ মিনিট বাকি ছিল। এরমধ্যে স্লোগান শোনা যায়, “রোকেয়া আপা, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।”
তলোয়ার মার্কার পোস্টার পোস্টার সাজিয়ে, ভোটের গান বাজিয়ে মহল্লায় বসে পড়ে ভিসিআরের লোকেরা। রোকেয়ার হয়ে কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতভর কলম মার্কার পোস্টার সাঁটে দেয়ালে দেয়ালে।
ভিসিআরের ভোটের প্রচারণার জনসভার উল্টোমুখে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ভাষণ শুরু করেন রোকেয়াও। ভোটারদের উদ্দেশ্যে রোকেয়া বলেন, “আপনাদের একেকটি মূল্যবান ভোট হচ্ছে নতুন সমাজ গড়ার হাতিয়ার।”
রোকেয়াকে প্রতিহত করতে গুন্ডাবাহিনীও লেলিয়ে দেয় ভিসিআর। ‘জিততে আমাকে হবেই’ পণ করে ভোটের আগে পুলিশকে ফোন দিয়ে ভিসিআর বলে, “ হ্যালো ওসি, ইলেকশন হবে হোক। তুমি তোমার লোকজন নিয়ে চোখকান বন্ধ করে রাখবে।”
তারিক মাহমুদের কাহিনী ও সংলাপে এরপর বড় পর্দায় আসে ভোটের দিন। নারী-পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ভোটের কক্ষে ভোটারকে নাম জিজ্ঞেস করছে পোলিং এজেন্ট। ব্যালট হাতে আলাদা সরে যায় বয়স্ক এক ভোটার। টেবিলে ব্যালট রেখে সিল দেওয়ার সময় মনে পড়ে ভিসিআরের কুকর্ম নিয়ে রোকেয়ার ভাষণ। ভোটটা তিনি কলম মার্কাতেই দেন। পর্দায় দেখা যায়, একে একে বাকি ভোটাররাও কলম মার্কায় সিল দিচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পরেই ভিসিআর চলে আসেন ভোটকেন্দ্রে। মাঠে অপেক্ষারত ভোটারদের বাড়ি চলে যেতে বলেন।
“ওদের ভোট দিতে হবে না। আমি ওদের ভোট পায়া গেছি।”
ভিসিআর লোক ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলে, ”প্রিয় জনগণ ভাই ও বোনেরা। আপনাদের কষ্ট করে ভোট দিতে হবে না। আপনাদের খেদমতের জন্য আমরা আপনাদের ভোট দিয়ে দেব।” মাঠে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটাররা এমন প্রস্তাবে সমস্বরে বিরোধীতা করে বলে ওঠেন, “না না আমরা ভোট দেব। যাকে খুশি তাকে ভোট দেব। ভোট না দিয়ে যাবো না।”
ভিসিআরের লোকেরা এরপর ভোটকেন্দ্রের দখল নিতে গুলি চালায়। ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে যায়। ভোট ছিনতাই করে জয় উদযাপনের মঞ্চে ওঠেন ভিসিআর। এই অশুভ শক্তি ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত ভিসিআরের প্রাণ বধ করে জেলে যান রোকেয়া।