দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সঙ্গে জমিয়ে তুলেছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভোটের ফলেও দেখা গেছে সেই চমক।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন জমিয়ে তুলতে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার সঙ্গে দলীয় অন্য নেতাদেরও ভোটে অংশ নেওয়ার পথ খুলে দিয়েছিল।
সেই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হল দলেরই কেন্দ্রীয় অনেক নেতার জন্য। প্রভাবশালী সেই নেতাদের হারতে হল স্থানীয় নেতাদের কাছে।
এদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং এবারে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহ আগের মতোই হেরেছেন, জয়ী হয়েছেন সেই মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
মাদারীপুর-৩ আসনে গোলাপ হেরেছেন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগমের কাছে। বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাপ পেয়েছেন ৬১ হাজার ৯৭১ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৬৩৩ ভোট।
মৃণাল মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে ৮২ হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে হেরেছেন। সে আসনে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল পেয়েছেন ৮৯ হাজার ৭০৫ ভোট।
নেত্রকোণা-৩ আসনে অসীম কুমার উকিল ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট পেয়ে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টুর (৭৬,৮০৩ ভোট) কাছে।
জাফর উল্যাহ ফরিদপুর-৪ আসনে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬ ভোট পেয়েছেন। গত দুইবারের সংসদ সদস্য নিক্সন তার চেয়ে ২৩ হাজার ৯৬৯ ভোট বেশি পেয়েছেন।
মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে হেরেছেন মাহবুব আলী, এনামুর রহমান ও স্বপন ভট্টাচার্য্য।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে মাহবুব হেরেছেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে। সুমন পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট, মাহবুব পান ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য যশোর-৫ আসনে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এয়াকুব আলীর কাছে। স্বপন নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট, এয়াকুব পেয়েছেন ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট।
সাভারে এনামুর এবং সাবেক এমপি তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদের পাল্লাপাল্লিতে ট্রাক প্রতীক নিয়ে জিতে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম। তিনি ভোট পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৪১২টি। মুরাদ পেয়েছেন ৭৬ হাজার ২০২ ভোট। তৃতীয় স্থানে থাকা এনামুরের ভোট ৫৬ হাজার ৩৬১।
আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলের বড় নেতাদের মধ্যে হেরেছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ।
কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে ইনু নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ভোট পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫টি। সেখানে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিন পেয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট।
পিরোজপুর-২ আসনে নৌকা প্রতীকের মঞ্জুকে (৭০,৩৩৩) হারিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ (৯৯,৭২৪)।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শরিফা কাদের ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরীর কাছে হেরে জামানতও খুইয়েছেন।
বর্তমান সংসদ সদস্যের মানিকগঞ্জের মমতাজ বেগম, যশোরের শাহীন চাকলাদার, বরগুনার ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, কুষ্টিয়ার সেলিম আলতাফ জর্জ, চট্টগ্রামে আবু রেজা মো. নিজামুদ্দীন নদভী, কক্সবাজারের জাফর আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম, গাজীপুরের মেহের আফরোজ চুমকি হেরেছেন।
ঢাকা-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আবু হোসেন বাবলা হেরেছেন। সেই আসনে নৌকার প্রার্থী সনজিদা খানমও জিততে পারেননি। জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওলাদ হোসেন।
রাজশাহী-২ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোট করেও হেরেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।
বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতে এসেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত। একই ভাবে টাঙ্গাইলে জিতেছেন আমানুর রহমান খান রানা।
বরিশাল-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ নাথ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পৌনে ২ লাখ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
আর এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবার সংসদে রেকর্ড সংখ্যক আসনে জয়ী হয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা না হলেও আওয়ামী লীগ ১৫০টির বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন নিশ্চিত করেছে। তবে বর্তমান সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়েও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা জিতেছে অর্ধশতের মতো আসনে।
অন্যবার আওয়ামী লীগ দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে বহিষ্কার করত। এবার চিত্র ছিল ভিন্ন।
বিএনপির বয়কটের মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। তা নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ আনতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয়নি।
দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নৌকার প্রার্থী মনোয়নের সময়ই বলেছিলেন, কোনো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত দেখতে চান না তিনি।
এরপর নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে প্রচার জমিয়ে তোলেন আওয়ামী লীগ পরিবারের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
তাতে প্রচার জমলেও ভোটের হারে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। এবার ভোটের হার ৪০ শতাংশের মতো বলে রবিববার ভোটগ্রহণ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান।
২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনেও ভোটের হার ছিল ৪০ শতাংশ। সেবার অর্ধেকের বেশি আসনে একক প্রার্থী হওয়ায় ভোটগ্রহণের প্রয়োজনও হয়নি।
এরপর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮০ শতাংশ।
৪০ শতাংশের নিচে ভোটের হার বাংলাদেশে দেখা গিয়েছিল একবারই। প্রায় সব দলের বর্জনের মধ্যে ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ২৬ শতাংশ।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপির হরতালের মধ্যেই এবারের নির্বাচন হয়। ভোটের দুই দিন আগে ট্রেনে আগুনে চারজনের মৃত্যুতে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাও দেখা দিয়েছিল।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশি বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহও ছিল বেশ। অবাধ নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্তও ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।
ফলে ভোট হলেও শঙ্কার মেঘ একেবারেই কেটে যাচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খানের ভাষ্যে, “নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ২০১৮ সালের বিশ্বব্যবস্থা আর এখনকার বিশ্বব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেসব বিবেচনা করলে সংকট বাড়বে অভ্যন্তরীণভাবে, আন্তর্জাতিকভাবেও।”