Beta
মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

নির্বাচনে এলে বিএনপি ভালো করতে পারত

হারুন-অর-রশীদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২২ আসনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বড় অংশও এই দলেরই নেতা, বাকিরা তাদেরই জোটের শরিক। সে হিসাবে বিরোধী দলহীন নতুন সংসদে প্রায় একচেটিয়াভাবে থাকছে আওয়ামী লীগই। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের আগামী দিনের করণীয় কী? প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি-ই বা আগামীতে কী করবে? এসব প্রশ্ন নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশীদের মুখোমুখি হয়েছিল সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আশফাকুর রহমান

নির্বাচনে এলে বিএনপি ভালো করতে পারত

হারুন-অর-রশীদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২২ আসনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বড় অংশও এই দলেরই নেতা, বাকিরা তাদেরই জোটের শরিক। সে হিসাবে বিরোধী দলহীন নতুন সংসদে প্রায় একচেটিয়াভাবে থাকছে আওয়ামী লীগই। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের আগামী দিনের করণীয় কী? প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি-ই বা আগামীতে কী করবে? এসব প্রশ্ন নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশীদের মুখোমুখি হয়েছিল সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আশফাকুর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: আপনি এক লেখায় বলেছিলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো হবে বলে মনে হয় না। আগামী নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হবে—এটা কাম্য এবং প্রয়োজনীয়।’ সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের নির্বাচনে কি আপনার প্রত্যাশা পূরণ হলো? এ নির্বাচনকে কি অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে?

হারুন-অর-রশীদ: ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হয়নি। এটা ভিন্ন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। ভিন্ন বলতে বোঝাচ্ছি যে, এ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বৈরী ছিল। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা, আয়োজন করা যাবে কিনা, সেটি নিয়েও আশঙ্কা-সন্দেহ ছিল। এমনকি নির্বাচনের দুই-তিন আগেও নির্বাচন স্থগিত করার দাবি তোলা হয়েছিল।

এমন প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন থেকে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, শান্তিপূর্ণ হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক হয়েছে দুই অর্থে— রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, ভোটারদের অংশগ্রহণ। এবারের নির্বাচনে ২৮টি দল অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। অধিকাংশ দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাতে করে কি এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়ে গেল? আসলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল আছে দুইটি। একটি হলো আওয়ামী লীগ। আরেকটি হলে বিএনপি-জামায়াত। গোটা সমাজ ও তথাকথিত সিভিল সোসাইটিও এই দুই ধারায় বিভক্ত। যদিও বাংলাদেশে কোনও সিভিল সোসাইটি নেই। সবই হলো পলিটিক্যাল সোসাইটি। দেশে যখন ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, তখন কোনও মানুষ এমন সহিংস-ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানায়নি। বরং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানানো হয়। এ কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাংঘর্ষিক। এমন প্রেক্ষপটে যেখানে মানবিকতাবোধ নেই, সেখানে কিভাবে যথার্থ অংশগ্রহণমূলক হবে সবকিছু?

আমাদের মানসিকতা অনেক বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এ মৌলিক অবস্থাকে না বুঝে আমরা যদি বলি, বিএনপি আসেনি বলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি তাহলে পুরো প্রেক্ষাপটের ভুল ব্যাখ্যা করা হবে। একটি দল স্বাধীনভাবে নির্বাচনে না আসার সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে আমাদের কি করার আছে? বরং নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মকভাবে এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক-নিরপেক্ষ-স্বচ্ছ করার চেষ্টা করেছে। ফলে বিএনপি না আসায় এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি সে কথা আমি বলতে পারি না। বরং দলীয় সরকার কিংবা স্পষ্ট করে বললে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও  প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হয়েছে এটা। অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে এ নির্বাচন। আমাদের এখন দরকার সঠিকভাবে গণতন্ত্র চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো গড়ে তোলা।

সকাল সন্ধ্যা: নির্বাচনের আগে পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, ‘মানুষ স্বতঃস্ফূতভাবে ভোট দিতে যাবে’। এই নির্বাচনে মানুষ কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে?

হারুন-অর-রশীদ: বাংলাদেশের মানুষ দুইভাগে বিভক্ত। ফলে বিএনপির যে ৩৩ শতাংশ সমর্থক রয়েছে তাদের তো ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার কথা না। তাদের কেউ ভোট দিতে যায়নি। বিএনপি-আওয়ামী লীগ একইসাথে নির্বাচন অংশগ্রহণ করলে তখন পরিস্থিতি আরেক রকম হয়। ভোটার উপস্থিতি আরও বেড়ে যেত। তবে ৪১ শতাংশ মানুষ এবার স্বতস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। নতুন প্রজন্ম ভোট দিয়েছে। তবে নির্বাচনের আগে সহিংস ঘটনা, হরতালের কারণে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক থাকায় ভোট দেওয়ার বিষয়ে অনেকে একটু ভীতির মধ্যে ছিল। 

সকাল সন্ধ্যা: নির্বাচনে ভোট দেওয়ার গড় হার ধীরে ধীরে বাড়ছিল। নির্বাচন কমিশনই বলেছে, দুপুর তিনটায় ভোটের গড় হার ছিল প্রায় ২৮ শতাংশ। কিন্তু মাত্র একঘণ্টা পর ভোটগ্রহণ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ভোট দেওয়ার গড় হার আনুমানিকভাবে প্রায় ৪০ শতাংশ। ভোটের হারের তথ্যে এমন অসামঞ্জস্য থাকা নিয়ে প্রবল সমালোচনা হয়েছে? আপনি কী মনে করেন?

হারুন-অর-রশীদ: এবারই প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন একটি ‘অ্যাপ’ ব্যবহার করেছে। যেন পুরো প্রক্রিয়ারটিতে জনসাধারণের কাছে স্বচ্ছতা তৈরি হয়। অবশ্য এ ধরনের বিশেষ ও জটিল পরিস্থিতি, বিশেষ করে নির্বাচনের ফল প্রকাশের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে এ প্রক্রিয়া যথাযথ হয়নি। কারণ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। আমি নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের কোনও কমতি ছিল না। আমাদের মতো দ্বিধাবিভক্ত সমাজে একটু তথ্যের গড়মিল ভুল প্রেক্ষাপটের জন্ম দেয়। তাই আমি বলব, এমন ঘটনা থেকে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা নেবে নির্বাচন কমিশন।

সকাল সন্ধ্যা: প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেছেন, ‘বিএনপি অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো। তার এ কথার সূত্র ধরে আপনার কাছে জানতে চাই, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি কি রাষ্ট্রের কাঠামো বা ব্যবস্থাপনায় কোনও ক্রটি দেখছেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অন্তরায় হিসেবে দেখা যেতে পারে?

হারুন-অর-রশীদ: প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হলো— আমাদের পারষ্পরিক রাজনীতি স্পষ্টভাবে দুটি আদর্শিক ধারায় বিভক্ত। যার আন্তঃসম্পর্ক সাংঘর্ষিক। এর সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এই অবস্থা যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না।

সকাল সন্ধ্যা: ২০০৮ সালেই শেষবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে জয়ী হয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে। ২০২৪-এর নির্বাচন নিয়ে এবার টানা তৃতীয়বার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচন আয়োজন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কী ধরনের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

হারুন-অর-রশীদ: এবারের নির্বাচন যথেষ্ট সুষ্ঠু হয়েছে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে। বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে। এছাড়াও প্রভাবমুক্ত হয়েছে এই নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচন একটি টার্নিং পয়েন্ট। দলীয় সরকারের অধীনে এ অবস্থার আরও উৎকর্ষতা ঘটাতে পারলে, পরিশীলিত হতে পারলে—আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরও এগিয়ে যেতে পারবে। গত ১৫ বছরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি ২০২৬-এ। দারিদ্র সীমা এখন ১৮ শতাংশ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ২০২৭-এর আগে দারিদ্র ১১ শতাংশে নেমে আসবে। এ শাসনকালে প্রায় সাত লাখ পরিবারকে বাড়ি দিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-কে বাদ দিয়ে সরকার নিজেই খাদ্যে ভুর্তকি দিয়েছে। এমন উন্নতি সারা বিশ্বের কাছে অভূতপূর্ব ঘটনা।

সকাল সন্ধ্যা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কেউ নির্বাচনে না আসার মানে এটা নয় যে গণতন্ত্র নেই। এটা তাহলে কেমন গণতন্ত্র? একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

হারুন-অর-রশীদ: গণতন্ত্র মানে হচ্ছে— মুক্তভাবে, নির্ভয়ে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসত চাইত অবশ্যই নির্বাচনে আসতে পারত। সরকার তো আইন করে বিএনপিকে নিষিদ্ধ করেনি। এমনকি এখনও জামায়াত নিষিদ্ধ হয়নি। বরং সরকারের ব্যর্থতা হলো যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে এখনো নিষিদ্ধ হয়নি জামায়াত। এছাড়া নির্বাচনের সময় গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। সরকার তো ভুয়া কোনও নির্বাচন করেনি। সরকার প্রধান এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ও সচেতন ছিলেন।

সকাল সন্ধ্যা: ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ‘বিএনপি’ নতুন করে নির্বাচন দাবি করেছে। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বছরের অক্টোবরে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনের দিনও দলটি হরতাল আহ্বান করে। নতুন সরকার গঠনের পরও যদি দলটির এমন আন্দোলন অব্যাহত থাকে তাহলে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আপনি মনে করেন?

হারুন-অর-রশীদ: সরকার গঠনের পর নতুন করে বিএনপির অস্থিতিশীলতা তৈরির সুযোগ আর নেই। সরকারের কাছে নির্বাচন আয়োজন করা ছিল খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সরকার সেটি সম্ভব করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে এমন নির্বাচন যে সম্ভব সেটি আমরা দেখেছি। ফলে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির যৌক্তিকতা আর নেই।  

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, বিএনপি নির্বাচনে আসবে। আমার সেই ভবিষ্যতবাণী সঠিক হয়নি। এটা না হওয়ার কারণ হলো, আমি যেভাবে বিষয়টি দেখেছি, আর যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচনে না আসার— এই দুই অবস্থান একদম ভিন্ন। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক-গবেষক হিসেবে বুঝেছি, রাজনীতিতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো একটিমাত্র উপায় নিয়ে থাকে না। তাদের মধ্যে নমনীয়ভাব থাকে। তারা নানা ধরনের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে। সার্বিকভাবে আমি যদি বলি, সরকারের একছত্র জনপ্রিয়তা তেমন একটা ছিল না। একটানা ১৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকায় ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাব দেখা দিয়েছিল। ২০১৮ সালের তুলনায় এবার বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা সুবিন্যস্ত ছিল, সুসংগঠিতও ছিল। তাছাড়াও মাঠের অবস্থা তাদের অনুকূলে ছিল। তারা যে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে এ কথা আমি কখনও বলিনি। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপি অপেক্ষাকৃত ভাল ফলাফল করবে এটা আমি ধারণা করেছিলাম। আর বিএনপির এক দফার আন্দোলন যে সফল হবে না সেকথাও আমি আগে বলেছি।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হলো— আমাদের পারষ্পরিক রাজনীতি স্পষ্টভাবে দুটি আদর্শিক ধারায় বিভক্ত। যার আন্তঃসম্পর্ক সাংঘর্ষিক। এর সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এই অবস্থা যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করা যায় না।

সকাল সন্ধ্যা: নির্বাচনের পর সরকার বৈধতা আর সংসদে বিরোধী দল কেমন হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল বিভিন্ন মহলে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা নিয়েও কথা বলেছেন কেউ কেউ। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে, ‘‘বিরোধী দলও কি আমরা গড়ে তুলব?’’ এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন?

হারুন-অর-রশীদ: সংসদীয় ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা আমাদের কাম্য। সরকারের ত্রুটি, গণবিরোধী ও জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে সঠিক পদক্ষেপের বিষয়ে তারা সোচ্চার ভূমিকা রাখতে পারে সংসদের ভেতরে ও বাইরে। ব্রিটেনে বিরোধী দলকে শ্যাডো কেবিনেট বলা হয়। আমাদের দেশে তো এখন এমন অবস্থা তৈরি হয়নি— গড়েও ওঠেনি।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে দলীয় ও স্বতন্ত্রভাবে সাতজন নির্বাচিত হয়েছিল। যে কারণে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বিচারে ওই সময়ে কোনও বিরোধী দল ছিল না। কিন্তু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত একাই সংসদে যেভাবে কথা বলেছে সেটা কোনও অংশে কম নয়। এবারের সংসদও এমন হতে পারে। এভাবে কেউ কেউ সরকারকে সঠিকভাবে পথ দেখানোর ভূমিকা নিতে পারে। আবার নিজেরা সংসদীয় জোট করে বিরোধী দলও করতে পারে। সবকিছুই যেখানে থাকবে প্রকাশ্য।

সকাল সন্ধ্যা: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, এ নির্বাচন ‘অবাধ’ ও ‘‍সুষ্ঠু’ হয়নি। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেও প্রায় একই বার্তা দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সদ্য নির্বাচিত সরকারকে ‘সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য আবশ্যক শর্তগুলো’ জোরদারের পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে দেশে মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, বিরোধী মত দমন ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নের মতো বহুল সমালোচিত বিষয়গুলো কতটা পাল্টাবে বলে মনে করেন?

হারুন-অর-রশীদ: তাদের এমন মন্তব্য সাময়িক। গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ দেশ ইতিমধ্যেই আমাদের নির্বাচনজয়ী নেতাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি পুরো বদলে যাবে। যে কোনও দেশ তার জাতীয় স্বার্থকে প্রধান করে দেখে। মানবাধিকার বিষয়টি যদি প্রধান হতো তাহলে ফিলিস্তিনে এ অবস্থা কেন? এমন কর্মকাণ্ডকে কারও তো সমর্থন করার কথা নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক আমাদের নির্বাচন সম্পর্কে প্রশংসা করেছে। বরং সরকারকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সুচিন্তিতভাবে সাবধানে দেশটি পরিচালনা করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বহুল উচ্চারিত একটি রেটোরিক। অবশ্য একটি দেশে গণতন্ত্র না থাকলেও উন্নয়ন হতে পারে, নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে চীন বা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র অন্যতম। উন্নয়নের প্রতি নজর দিতে গিয়ে কি বাংলাদেশ এই মৌল ভিত্তি বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও চর্চা থেকে সরে গেছে বলে মনে করেন কি?

হারুন-অর-রশীদ: বাংলাদেশে যে সাংঘর্ষিক রাজনীতি, এর মধ্যে যে উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারছে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন তো হতে পারত যে এখানে সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে যেতে পারত। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না লাভ করার কারণ ভিন্ন। এখানে সকল দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি হলো আদর্শিক। এখানে এত রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটিই সরকারের কৃতিত্ব। উদাহরণ হিসেবে একটি দেশের কথা উল্লেখ করি। ১৯৫৫ সাল থেকে জাপানে এখন পর্যন্ত একটি দলই ক্ষমতায় রয়েছে। এলডিপি দল। এটাকে এলডিপি মডেলও বলা হয়। কেউ কি কখনও প্রশ্ন করেছে জাপানে গণতন্ত্র নেই কেন?

সকাল সন্ধ্যা: আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনেজয়ী হয়ে পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় আসছেন। একইসঙ্গে তিনি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা নারী সরকারপ্রধান হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছেন। এই ‘হাসিনাকাল’-কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? কী প্রত্যাশা করছেন?

হারুন-অর-রশীদ: আমার প্রত্যাশা যে,প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে—এমন একটি বিরোধী দল গঠন করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এটা দেশের স্বার্থে, আওয়ামী লীগের স্বার্থে, সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন। তিনি দেশকে নানাভাবে অনেককিছু দিয়েছেন, অনেক নতুন কিছু দেশের প্রয়োজনে উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। দারিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অবিরাম কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা দেশের জন্য কাজ করবেন— কল্যাণ করবেন আজীবন এমনই হওয়া কথা। এর ব্যতয় ঘটনার কোনও সুযোগ নেই।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

হারুন-অর-রশীদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত