Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

‘এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার, নির্বাচন করা মূল কাজ নয়’

নাহিদ ইসলাম

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রধান মুখ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের আগে কোনও নির্বাচন নয়। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দেওয়াই মূল কর্তব্য বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বতী সরকারের অন্যতম মুখপাত্রে পরিণত হওয়া নাহিদ ইসলামের জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকায়। বহুল আলোচিত জেন-জি প্রজন্মের এই প্রতিনিধি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছেন। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক অনিক রায়

‘এটা গণঅভ্যুত্থানের সরকার, নির্বাচন করা মূল কাজ নয়’

নাহিদ ইসলাম

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রধান মুখ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের আগে কোনও নির্বাচন নয়। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দেওয়াই মূল কর্তব্য বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা থেকে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বতী সরকারের অন্যতম মুখপাত্রে পরিণত হওয়া নাহিদ ইসলামের জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকায়। বহুল আলোচিত জেন-জি প্রজন্মের এই প্রতিনিধি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছেন। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক অনিক রায়

সকাল সন্ধ্যা: আন্দোলন চলাকালীন আপনি দুই দফায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে আটক ছিলেন? সেই দিনগুলোতে কী হয়েছিল আপনার সাথে?

নাহিদ ইসলাম: আন্দোলনের সময় দুই দফায় গোয়েন্দা সংস্থা আমাকে তুলে নিয়ে যায়। আমার সাথে আরও কয়েকজন সমন্বয়ককেও তুলে নিয়ে যায়। সারা দেশেও বিভিন্ন সমন্বয়ক এবং আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল। তুলে নিয়ে যাওয়ার আগেও আমাদের কয়েকদফায় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আন্দোলন থামানোর জন্য ভয়-ভীতি বা প্রলোভন দেখাচ্ছিল। সেগুলো যখন ব্যর্থ হয়, তখনই আমাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন থেকে সরে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল।

প্রথমবার তো আমার উপর অনেক নির্যাতন করা হয়। আমি যেন আন্দোলন স্থগিত করি এজন্য আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বলে দেওয়া হয় আমি যদি আন্দোলন স্থগিত না করি তাহলে পরের বার তুলে আনলে আর আমাকে পাওয়া যাবে না। আমাকে গুম করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।

এরপর তারা আমাদের সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে আলোচনার একটি সাজানো নাটক করতে চেয়েছিল। আমরা এটি বুঝে সেখানে অনশন শুরু করি। আমরা সেসময় প্রায় ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলাম। বাহিরে শিক্ষক, ছাত্র, জনতার আন্দোলনের ফলে শেষপর্যন্ত আমরা ছাড়া পেলাম।

পরে যখন হসপিটালে ভর্তি হলাম, সেখানেও আমাকে একপ্রকার জিম্মি করে রাখা হয়। রুমে ওয়াইফাই, টেলিভিশন লাইন কেটে দেওয়া হয়। এমনকি সাংবাদিকদের আমার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। একসময় মোবাইলও জোর করে তারা নিয়ে যায়। এরপর তো আবারও আমাদের ছয়জনকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের আটক করে রাখা হয় নিরাপত্তার নামে। আমাদের নির্যাতন করে, হুমকি দিয়ে আমাদের দিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ানো হয়।

এরপর তারা আমাদের সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে আলোচনার একটি সাজানো নাটক করতে চেয়েছিল। আমরা এটি বুঝে সেখানে অনশন শুরু করি। আমরা সেসময় প্রায় ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলাম। বাহিরে শিক্ষক, ছাত্র, জনতার আন্দোলনের ফলে শেষপর্যন্ত আমরা ছাড়া পেলাম।

সকাল সন্ধ্যা: আটক থাকার দিনগুলোতে আপনার কি অনুভূতি ছিল? সেই সময়টায় কী ভাবতেন?

নাহিদ ইসলাম: প্রথমবার যখন নিয়ে গেল, তখন তো ভাবিই নাই যে ফেরত আসতে পারব। মনে হচ্ছিল এখানেই হয়ত শেষ। এরপর দ্বিতীয় দফায় যখন নিয়ে গিয়ে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হলো, সেসময় মনে হচ্ছিল আন্দোলন মনে হয় এখানেই শেষ। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল। বের হতে পারব তা ভাবি নাই। ভেবেছিলাম আমাদের নামে মামলা হবে তারপর রিমান্ডে যেতে হবে। বুঝতে পারছিলাম, বাহিরেও এরকম দমন-পীড়ন চলছিল। দুইবার আটকের পর সেখান থেকে বের হয়ে আসা আসলেই সৌভাগ্যের বিষয়। সাধারণ মানুষের আন্দোলনের ফলেই আমরা এখনও জীবিত আছি। এজন্য আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ।

সকাল সন্ধ্যা: জুলাই মাসের ১ তারিখে আপনারা যখন রাজপথের আন্দোলনে নামলেন, তখন কি ভেবেছিলেন এক মাস পরই সরকার পড়ে যাবে?

নাহিদ ইসলাম: আরে না। আমরা তো কখনো ভাবি নাই এই আন্দোলন থেকে সরকার পড়ে যাবে বা এই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনের দিকেও যাবে। আমরা নিরেট কোটা সংস্কারের দাবিতেই এই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আমরা আসলে চাচ্ছিলাম যেন বেশিদিন আমাদের এই আন্দোলন করতে না হয়। অনেক বড় আন্দোলন হবে তাও ভাবি নাই। পড়ার টেবিল থেকে এসে আন্দোলন করা তো সবার জন্য স্বস্তিকর না। তাও আবার একই আন্দোলন। যেটা ২০১৮ সালে আমাদের করতে হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতিত হতে হয়েছে। এবারও কোটা সংস্কারের দাবিতেই আসলে আন্দোলনটা করা। সরকার নির্যাতন ও দমন-পীড়নের যে পথ বেছে নিয়েছিল সেটাই তাদের পতনের কারণ। যখন আন্দোলনে এত মানুষকে শহীদ করা হলো। তখন আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। ফলে সেটা সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হওয়া অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল।

আরে না। আমরা তো কখনো ভাবি নাই এই আন্দোলন থেকে সরকার পড়ে যাবে বা এই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনের দিকেও যাবে। আমরা নিরেট কোটা সংস্কারের দাবিতেই এই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আমরা আসলে চাচ্ছিলাম যেন বেশিদিন আমাদের এই আন্দোলন করতে না হয়। অনেক বড় আন্দোলন হবে তাও ভাবি নাই। পড়ার টেবিল থেকে এসে আন্দোলন করা তো সবার জন্য স্বস্তিকর না। তাও আবার একই আন্দোলন।

মানুষের এত বছরের ক্ষোভ বের হয়ে আসল। দেশের বাজে অর্থনৈতিক অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলে ফেলেছিল। এই সরকারের পতনের মাধ্যমেই মুক্তি আসতে পারে সেই সম্ভাবনা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এজন্যই বাংলাদেশের সবাই রাজপথে নেমে এসেছিল।

সকাল সন্ধ্যা: গুঞ্জন চলছে যে আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল, এটা কি আসলেই ঘটেছিল?   

নাহিদ ইসলাম: আন্দোলন ৩৬ দিন ধরে চলেছে। আন্দোলনটা যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের বেশিরভাগকেই ক্যাম্পাসের মানুষ চেনে। বিভিন্ন আন্দোলনে তারা ছিল। সরকার কিন্তু তাদের সম্পর্কে অবহিত ছিল। আন্দোলনের পুরো সময়টাতেই সরকার অপপ্রচার করার চেষ্টা করেছে। বিএনপি-জামায়াত, বিরোধী দলের উসকানি রয়েছে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হচ্ছে এরকম নানা ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকার কোনওদিন এসব ট্যাগিং প্রমাণ করতে পারেনি। আমাদের দুই দফায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের মোবাইল, ল্যাপটপ তারা নিয়ে গিয়েছিল। এরকম কোনও তথ্য বা প্রমাণ কিন্তু তারা বের করতে পারেনি। এটা আসলে পুরোটাই অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা। এখন আন্তর্জাতিকভাবে ফ্যাসিস্টদের শক্তি বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব প্রচারণা করছে। তারা বোঝাতে চাচ্ছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই সরকারের পতন করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মানুষের ক্ষোভ, সরকারের দমননীতি এবং যে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা কায়েম করেছিল তার বিরুদ্ধেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে নেমে এসেছে এবং সফল করেছে।

সকাল সন্ধ্যা: নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলোচনা করছে সবাই। আপনিও একথা বলেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিভাবে হবে এই বন্দোবস্ত? এর জন্য কি কি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

নাহিদ ইসলাম: আমরা আমাদের স্বাধীন দেশে অনেকগুলো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেখতে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পর একটা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হয়েছিল। কিন্তু বাকশাল তৈরির মাধ্যমে আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে নব্বই সালে আমরা আরেকটা বন্দোবস্তে গেলাম। একটা সংসদীয় কাঠামো শুরু হলো। কিন্তু তাও কিন্তু টিকল না। ১/১১ তে আরেকটা বন্দোবস্ত হলো। যেটার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে এবং ফ্যাসিজম তৈরি করা হয়েছে।

আমরা বলতে চাচ্ছি, আগের কোনও বন্দোবস্তেই আমরা আর যেতে পারব না। যেহেতু একটা অভ্যুত্থান হয়েছে। আগের সব বন্দোবস্ত ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আমাদের একটা নতুন বন্দোবস্তে যেতেই হবে। ফলে এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে শক্তি তাদেরকে নিয়েই এই বন্দোবস্ত হতে পারে। বন্দোবস্তের মূল লক্ষ্যই হবে, আর যাতে কোনওদিন বাংলাদেশে ফ্যাসিজম বা কোনও রকমের স্বৈরতন্ত্র কায়েম না হতে পারে। আমাদের গণতন্ত্র এবং ন্যায় বিচারের জন্য যে দীর্ঘ লড়াই সেটা যাতে বাস্তবায়িত হয়। আমাদের যে দ্বিধাবিভক্ত জাতি, তা যেন আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পারি। এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আমরা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা ভাবতাছি।

সকাল সন্ধ্যা: এই সরকারকে প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ভিন্ন উদাহরণ তৈরি করার কথা বলছেন অনেকেই। কিন্তু সেরকম উদ্যোগ কম দেখতে পাওয়ার আক্ষেপও প্রকাশ করছেন। এই বিষয়ে আপনি কি বলবেন? সরকার কি কোনও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?

নাহিদ ইসলাম: আগের সরকারের কিন্তু কোনও জনসমর্থন ছিল না। পুরোপুরি একটা আমলা নির্ভর সরকার ছিল। ফলে তাকে সবসময় প্রশাসনের উপরই নির্ভর করতে হয়েছিল। এই প্রশাসনকে কাজে লাগিয়েই মানুষের উপর নির্যাতন এবং জুলুম হয়েছিল।

আমরা যেহেতু একটি অভ্যুত্থানের সরকার। সেই কারণে মানুষের আস্থা আমাদের উপর আছে। গত ১৬ বছরে আমাদের মতপ্রকাশের জায়গা সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। কেউ তার দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারেনি। এখন সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা আছে দেখেই মানুষ কিন্তু দাবি দাওয়া নিয়ে আসছে। আমরাও সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু সমাধান করতে চাই। সকলের দাবিই কিন্তু শোনা হচ্ছে। এই সংকটকালীন সময়েও কিন্তু অনেক দাবি পূরণ করা হচ্ছে।

একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো, সরকার এবং প্রশাসন কিন্তু ভিন্ন। নতুন সরকার আসলেও তাদের প্রশাসন কিন্তু আগেরটাই রয়ে গেছে। নিয়ম নীতি থেকে ব্যক্তিগুলো সবই কিন্তু আগের। ফ্যাসিস্ট কাঠামো কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। আমলাতন্ত্রের মধ্যে যতক্ষণ না সংস্কার আনতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত এটার চূড়ান্ত সমাধান হবে না। সে পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ প্রশাসনকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলা। সেটা যদি আমরা করতে পারি তখনই মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।

আমরা কিন্তু সবার সাথে বসছি। দীর্ঘ মেয়াদে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় সেই উদ্যোগ নিচ্ছি। সেই বিষয় নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি। দেখুন শ্রমিক আন্দোলন হচ্ছে। আমরা কিন্তু শ্রমিক নেতাদের সাথে কয়েক দফায় বসেছি। তাদের অনেকেই কিন্তু বলেছে তারা কেউ সচিবালয়ে ঢুকে মিটিং করবে এটা তাদের জন্য অকল্পনীয় ছিল। আমরা আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছি।

কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো, সরকার এবং প্রশাসন কিন্তু ভিন্ন। নতুন সরকার আসলেও তাদের প্রশাসন কিন্তু আগেরটাই রয়ে গেছে। নিয়ম নীতি থেকে ব্যক্তিগুলো সবই কিন্তু আগের। ফ্যাসিস্ট কাঠামো কিন্তু এখনও রয়ে গেছে। আমলাতন্ত্রের মধ্যে যতক্ষণ না সংস্কার আনতে পারব ততক্ষণ পর্যন্ত এটার চূড়ান্ত সমাধান হবে না। সে পরিকল্পনা আমাদের আছে। আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ প্রশাসনকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলা। সেটা যদি আমরা করতে পারি তখনই মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।

সকাল সন্ধ্যা: সংবিধান পরিবর্তনের আলোচনাও হচ্ছে। আপনি ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কি মনে করেন? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সংবিধানের মূল প্রস্তাবের কতটুকু রাখা উচিৎ? বাদ যাওয়ার মতো কিছু কি আছে?

নাহিদ ইসলাম: আমাদের সংবিধান নিয়ে কিন্তু অনেক দিন ধরেই আলাপ আছে, সমালোচনাও আছে। সংবিধানকে বারবার কাটাছেড়া করা হয়েছে। বিগত যে ফ্যাসিবাদী সরকার সেও কিন্তু এই সংবিধানের উপর ভর করে এসেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই হয়ে গিয়েছে, ভোটের অধিকার আমরা হারিয়েছি সব এই সংবিধান দিয়েই জায়েজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সংবিধানের প্রতি তাই মানুষের একটি অনাস্থা তৈরি হয়েছে।

৭২-এর সংবিধানে মুজিববাদের যে নীতি বা আওয়ামী লীগের যে নীতি সেটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার এই সংবিধানে মানবাধিকারসহ নানান যৌক্তিক জিনিস রয়েছে। সেগুলো নিশ্চয়ই থাকবে। সংবিধানের যে জায়গাগুলো নিয়ে সমালোচনা বা সমস্যা রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে। যেমন প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামো আমাদের সংবিধানে আছে। এই জিনিসগুলো কিন্তু পরিবর্তিত হতে হবে। মানুষের মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তার ভিত্তিতে আমাদের সংবিধানকে সাজাতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রত্যাশা এই সরকারের রয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন আসছে, তার জন্য কত দিন প্রয়োজন? নির্বাচন কবে নাগাদ হবে? আপনি কি মনে করছেন?

নাহিদ ইসলাম: সংস্কারের আগে কোনও নির্বাচন নয়। এটা কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার না যে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই আসলে তার মূল দায়িত্ব। এটি অভ্যুত্থান থেকে আসা সরকার। অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকে বাস্তবতায় পরিণত করা এই সরকারের প্রধান কর্তব্য।

সংস্কার ব্যতীত একটি নির্বাচন কোনও কাজে দেবে না। সংস্কার বা এর রূপরেখা কিংবা সময় কোনও কিছুই সরকার এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে না। সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি এবং অভ্যুত্থানকারী শক্তি তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সরকারের মেয়াদ কিংবা সংস্কারের রূপরেখা ঠিক হবে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে কিন্তু আলোচনা চলছে। আলোচনার মাধ্যমেই এটি নিশ্চিত করা হবে।

সংস্কারের আগে কোনও নির্বাচন নয়। এটা কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার না যে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই আসলে তার মূল দায়িত্ব। এটি অভ্যুত্থান থেকে আসা সরকার। অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাকে বাস্তবতায় পরিণত করা এই সরকারের প্রধান কর্তব্য।

আমরা আলোচনা করছি। সার্বিকভাবে যদি সবাই একটি কাউন্সিল বা কোনও কমিটি তৈরি করতে চায় তখন সেটা নিশ্চয়ই বিবেচনা করা হবে।

সকাল সন্ধ্যা: গণঅভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে আপনি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। আপনারা সাইবার নিরাপত্তা আইন, উপাত্ত সুরক্ষা আইনসহ বিতর্কিত আইনগুলোর বিষয়ে কী ভাবছেন, কী করবেন?

নাহিদ ইসলাম: আমাদের গণমাধ্যমের বা মতপ্রকাশের উপর যেসব (বিতর্কিত) আইন রয়েছে সেসব আইন আমরা বাতিল বা সংশোধন করব। সেজন্য একটি গণমাধ্যম কমিশনের কথা ভাবা হচ্ছে। সাংবাদিক সমাজ এবং নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আমরা সংস্কার করব।

সকাল সন্ধ্যা: ফোনে আড়ি পাতা এবং বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য/ বার্তা গোপনে নজরদারির অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসব করতে কিছু সফটওয়্যার ও স্পাইওয়্যার কেনা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সোশাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং প্রোপাগান্ডার। এসব বিষয়ে কী করবেন আপনারা?

নাহিদ ইসলাম: ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এটার উপর রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি সে কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য এটি করেও এটা গোপনীয় থাকতে হবে। সেটা জনসম্মুখে আসতে পারে না। আমরা কল রেকর্ড ফাঁস হতেও দেখেছি। এটা কিন্তু একটা অগণতান্ত্রিক চর্চা।

আবার একইসাথে মানুষের তথ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা মানুষের এক্সেস টু ইনফরমেশন নিশ্চিত করতে কাজ করব। আগের যে অভিযোগ রয়েছে, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সময় মত মানুষকে জানানো হবে।

সকাল সন্ধ্যা: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন? আমরা দেখেছি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় সরকারের সময়েই দলীয় বিবেচনায় লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে নীতিমালায় কি কোনও পরিবর্তনের উদ্যাগ নেবেন?

নাহিদ ইসলাম: সংবাদ মাধ্যমকে সরকারের কাছে জবাবদিহি আমরা করাতে চাই না। এটা স্বাধীনতাকে খর্ব করে। এইজন্য আমরা সরকার এবং সংবাদমাধ্যমের মধ্যে মাঝামাঝি এই গণমাধ্যম কমিশনের কথা ভাবছি। সেটা একটা সমাধান হতে পারে।

একই সঙ্গে আমাদের সাংবাদিক সমাজকেও নতুন করে ভাবতে হবে। সেখানেও নতুন আলাপ আসতে হবে। নিজেদের জায়গা থেকে উদ্যোগটা নিতে হবে। ওখানে আসলে এই দ্বি-দলীয় রাজনীতি চলে। সে জায়গা থেকে আমাদের আহ্বান থাকবে তারা যেন বের হয়ে আসে। নিজেদের জায়গা থেকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে।

একই সঙ্গে আমাদের সাংবাদিক সমাজকেও নতুন করে ভাবতে হবে। সেখানেও নতুন আলাপ আসতে হবে। নিজেদের জায়গা থেকে উদ্যোগটা নিতে হবে। ওখানে আসলে এই দ্বি-দলীয় রাজনীতি চলে। সে জায়গা থেকে আমাদের আহ্বান থাকবে তারা যেন বের হয়ে আসে। নিজেদের জায়গা থেকে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করে।

আগে সরকারের পক্ষ থেকে নানান রকমের ভয়-ভীতি বা বাঁধা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এমনকি প্রলোভনও থাকে। আমরা এটি নিশ্চিত করব যে, এই সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। নিয়ম-নীতিমালাও এমনভাবে করব যাতে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে যেতে পারে। সকলে মিলে যদি অঙ্গীকারবদ্ধ হই তাহলে এটি সম্ভব।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী বলে মনে করেন? তারা কি বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার অধিকার পাবে না?

নাহিদ ইসলাম: আমরা বলছি ফ্যাসিস্ট কাঠামোকে পরিবর্তন করতে হবে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন করে নিপীড়নমূলক যে চরিত্র তা পূরণ করা সম্ভব না। আমরা তাই সংস্কারের কথা বলছি। বিগত সময়ে কিন্তু শুধু জুলাই হত্যাকাণ্ড না গুম, খুন, মানবাধিকার এবং ভোটাধিকার হরণ করেছে এই আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা যারা এসব কাজ করতে সহযোগিতা করেছে তাদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই। অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা যে আর নতুন ফ্যাসিজম দাঁড়াবে না। ফলে আওয়ামী লীগের বিচার প্রক্রিয়া বাদে কোনওভাবেই পুর্নবাসনের কোনও সম্ভবনা নেই। বিচারের মধ্য দিয়ে জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে আওয়ামী লীগ আর রাজনীতি করতে পারবে কিনা। দরকার পড়লে তাকেও নতুন রূপে আসতে হবে। তার যে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ সেটা পরিবর্তন করলে জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে তাদের রাজনীতি আর বাংলাদেশ থাকবে কিনা।

সকাল সন্ধ্যা: উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের আশঙ্কা করছে কেউ কেউ? এর কি সুযোগ রয়েছে?

নাহিদ ইসলাম: গত ১৬ বছর ধরে কিন্তু আওয়ামী লীগ এই ভয় দেখিয়েই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তাদের আমলেই কিন্তু আমরা বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা দেখেছি। আমরা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর উপর হামলা দেখেছি। তাদের সম্পত্তি দখল করতে দেখেছি। তারা নিজেদের সংখ্যালঘুবান্ধব সরকার বললেও একটি ঘটনারও বিচার করতে আমরা দেখিনি। ফলে, এটি আওয়ামী লীগের একটি প্রোপাগান্ডা।

বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র অবশ্যই গণতান্ত্রিক হবে। আমরা যে সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচারের কথা বলি তা নিশ্চিত থাকবে। জঙ্গিবাদ এবং রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কার্যক্রমের সুযোগ এখানে দেওয়া হবে না।

সকাল সন্ধ্যা: কয়েকদিন আগেও আপনি ছিলেন রাজপথের নেতা, তখন অনেক দাবি ছিল; বর্তমানে আপনি সরকারের উপদেষ্টা। আপনাদের এতদিনের চিন্তা-ভাবনা ও চাওয়ার সঙ্গে নতুন পথে এগোনো কতটা সহজ মনে হচ্ছে? কোনও বাধা পাচ্ছেন কি?

নাহিদ ইসলাম: খুব একটা ভিন্ন না। আগে রাজপথে থেকে জনগণের দাবিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছি। এখন সরকারে থেকেও একই কাজ করার চেষ্টা করছি। পদ্ধতিগত জায়গায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখানেও নানা ধরনের বাধা আছে। এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। আমরা এখন সংকটকালীন মুহুর্তে আছি। গত ১৬ বছরের ময়লা সাফ করতে হচ্ছে। এই বোঝা কিন্তু নতুন সরকারের কাঁধে এসে পড়েছে। জনগণের প্রচুর প্রত্যাশা আছে আমাদের প্রতি। কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজের গতি আমরা আনতে পারছি না। তবে যেহেতু জনগণের সমর্থন আছে। সবাই নতুন করে ভাবতে চাচ্ছে। আমরা আশা করি খুব শিগগিরই এই বাধা অতিক্রম করে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাহিদ ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত