হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা সদরের পাশেই পীরবাজার গ্রাম, সেখানেই সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের বাস। তার বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই কানে এল ‘ঈগল-ঈগল’ স্লোগান। কাঠ ও রবারের তৈরি একটা ঈগল ধরাধরি করে সেই ডুপ্লেক্স বাড়ির ফটকের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিলেন মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি। নাম তার কেফায়েত উল্লাহ, এসেছেন পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। নিজ হাতেই তিনি বানিয়েছেন এই ঈগল, তা সুমনকে উপহার দিতে নিয়ে এসেছেন।
অন্য এলাকার হয়েও কীভাবে সুমনের ভক্ত হলেন? কেফায়েত জানালেন, দীর্ঘদিন ধরেই ফেইসবুকে সুমনকে লক্ষ্য করছেন তিনি। বিভিন্ন ভিডিও ও লাইভে সুমনের কথা শুনে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে, সেই সঙ্গে আস্থাও।
সোশাল মিডিয়ায় সুমনের এমন ভক্তের সংখ্যা অনেক। শুধু ফেইসবুকেই তার অনুসারী ৫৫ লাখের বেশি। সেখানে চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত যে হবিগঞ্জ-৪ আসনে তিনি সংসদ সদস্য প্রার্থী হয়েছেন, সেখানে ভোটার সাকুল্যে ৫ লাখ ১২ হাজার ৩০৮ জন। অর্থাৎ ১১ ভাগের এক ভাগ।
সুমন একজন আইনজীবী, পড়ে এসেছেন যুক্তরাজ্য থেকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাজনীতিতে যুক্ত ছাত্রজীবন থেকেই, ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তবে এসব ছাপিয়ে এখন তার পরিচয় বলতে গেলে সামনে আসে ‘সোশাল মিডিয়া সেলিব্রিটি’, অন্তর্জালে সবাই তাকে চেনে ‘ব্যারিস্টার সুমন’ নামে।
সেই পরিচয় নিয়েই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জে নিজের এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৪৩ বছর বয়সী সুমন। ঈগল প্রতীক নিয়ে পাল্লা দিচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর নৌকার সঙ্গে।
গত নির্বাচনে ৩ লাখ ভোট পেয়ে জেতা মাহবুবের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা সুমন সোশাল মিডিয়াকেই নিজের ‘শক্তি’ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন। এলাকার পাশাপাশি সারাদেশ, এমনকি বিদেশ থেকেও পাচ্ছেন ভক্তদের সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্ত্রীও এসেছেন স্বামীর জন্য ভোট চাইতে।
সুমন নিজেও এখন শশব্যস্ত প্রচারে। সেই ভোর ৬টায় বের হন বাড়ি থেকে, ফেরেন রাত ১২টায়। এই ব্যস্ততার মধ্যে সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুমন বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটা হাতিয়ার মানুষকে কথা শোনানোর। আমি এটা পাওয়ার পর চেষ্টা করেছি আমার ভালো কাজগুলো সারা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। এজন্য সামাজিক মাধ্যম আমার শক্তি বলতে পারেন আপনি।”
ফেইসবুকসহ সোশাল মিডিয়া আজকের দুনিয়ায় নির্বাচনী প্রচারের বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তবে সুমনের ক্ষেত্রে তা অন্যদের মতো নয়। নানা অঙ্গনb থেকে সোশাল মিডিয়ায় পরিচিতি নিয়ে পরে কেউ কেউ ভোটের ময়দানে নামলেও সুমন এগিয়েছেন ভোটকে লক্ষ্য করেই।
এলাকার নিজের নানা উদ্যোগের প্রচারে ফেইসবুককে এক যুগ আগে থেকে ব্যবহার করে আসছেন তিনি। ২০১৪ সালের তার ফেইসবুক ঘেঁটে দেখা যায়, শুধু জুলাই মাসেই তিনি ১৩টি পোস্ট দিয়েছেন, যার বেশ কয়েকটি নিজের নানা কর্মসূচি নিয়ে।
এলাকাকে ঘিরেই ছিল সুমনের এসব কাজ, যার মধ্য দিয়ে তার নির্বাচনী অভিলাষ মূর্ত হয়ে ওঠে। তার ভাষায়, “আমি কিন্তু এলাকার বাইরে কোনো খুব বেশি কাজ করিনি। এলাকার কাজটাই সমাদৃত হইছে সারা দেশে।”
নিজের এলাকায় ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা, অর্ধশতের মতো সেতু নির্মাণে সহায়তা, দু্ই বছর আগে সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাজগুলোতেও সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেছেন সুমন।
তিনি বলেন, “সিলেটে বন্যার সময় আমি শূন্য হাতে গিয়েছিলাম। আমার এক ভিডিওতে মানুষ ৩ কোটি টাকা আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের মাটিতে ১০৭টি বাড়ি বানিয়ে আসছি।
“এলাকাতে কাজ করছি বলেই তো ৪৯টা ব্রিজের জন্য তো ৪৯টি ভিডিও হইছে আমার। প্রতিবাদের জন্য ভিডিওগুলা সোশাল মিডিয়াতে নিয়ে আসছি। সেজন্য আমি চার দিক থেকে সুবিধা পাচ্ছি।”
সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুমন যখন ছুটছেন, তখন তার পাশে ব্যক্তিদের মধ্যে তরুণদেরই বেশি দেখা যায়। এদের অনেকে নিজে ভোটারও নন, তবে ভোট চাইছেন সুমনের জন্য।
কেফায়েত বলেন, “সুমন ভাই উদ্যোগী মানুষ। আল্লাহ উনাকে সংসদে বসাইলে উনি দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারবেন। দেশ বদলাতে সুমন ভাইয়ের মতো মানুষের প্রয়োজন।”
সুমনের লক্ষ্য, নানা বিষয়ে তার সোশাল মিডিয়ার সরবতা নিয়ে যাবেন সংসদে। “এমপি হলেও সোশাল মিডিয়াতে কাজ করব। সোশাল মিডিয়ায় যে প্রতিবাদ, এটা আমি সংসদের ভেতরে নিয়ে যাব।”
আবার একইসঙ্গে প্রতিশ্রুতি দেন, সংসদ সদস্য হতে না পারলেও তার কাজে কোনো ছন্দপতন আসবে না।
“আমার তো এমন না যে এমপি হতেই হবে। এমন না যে এমপি হওয়ার জন্য আমি অনেক ইনভেস্ট করেছি, এখান থেকে আমাকে অনেক টাকা তুলতে হবে। আমি সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছি, সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছি। রাজনীতি আমার ইনভেস্টমেন্ট না, এটা আমার সেবা করার মাধ্যম।”
নৌকা বাঁচাতে নৌকার বিরুদ্ধে!
হবিগঞ্জ-৪ আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের দখলে। ১৯৯১ সাল থেকে জয়ী হয়ে আসছিলেন এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। তার মৃত্যুর পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন মাহবুব আলী।
আওয়ামী লীগ সমর্থক সুমন এক দশক ধরে নিজেকে তৈরি করে তারপর এবার নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে তা না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপিবিহীন এবারের নির্বাচনে নিজ দলের কারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের বাধা ছিল না। আর এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন তিনি।
সুমনের ভাষায়, “দেখুন আমি কি জানতাম, জননেত্রী শেখ হাসিনা নৌকা একজনকে দিয়ে পারমিশন দিবেন আরেকজনকে। এটা তো রিসেন্ট উনার সিদ্ধান্ত। উনি একজনকে নৌকার নমিনেশন দিলেন, আমাকে স্বতন্ত্র পারমিশন দিলেন। আমার কখনও বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নাই। আমি নৌকার বাইরে নির্বাচন করব, এটা এখনও আমার চিন্তায় নাই।”
সেক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইয়ের ব্যাখ্যা সুমন টানছেন এভাবে- “নেত্রী অনুমতি দিয়েছেন, নৌকাকে বাঁচাতে গেলে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করা লাগবে। বিশ্বে যে ষড়যন্ত্র চলছে স্যাংশন দেওয়ার, এসব জিনিস থেকে বাঁচাতে গেলে ….
“শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা আমার উদ্দেশ্য। তিনি যদি বলেন, আমি চলে যাব। এমপি হওয়ার কোনো মিশন আমার না, আমার মিশন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে শেখ হাসিনাকে সফল করা।”
বর্তমান সংসদ সদস্য মাহবুব আলীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের পাশাপাশি এলাকায় কোনো কাজ না করার অভিযোগও তোলেন সুমন।
নিজেকে সেই আসনের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখানে বলে রাখি, মাঝি দুর্বল হলে নৌকা দুর্বল হয়ে যায়। নৌকা কিন্তু নিজে নিজে চলতে পারে না। এখানে একটা মাঝি লাগে। আমার নির্বাচনটা হচ্ছে মাঝি বদলের নির্বাচন”
নানা কিছু নিয়ে সমালোচনামুখর হলেও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সুমনের সুর অনেক নরম, এমন অভিযোগ অনেক দিনের।
এনিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সুমনের উত্তর, “আমি কি ব্যক্তি না প্রতিষ্ঠান? ব্যক্তির তো লিমিটেশন আছে। একটা ব্যক্তি কি সারাদেশে দুদকের মতো কাজ করতে পারবে।
“আমি তো চে গেভারা হতে আসি নাই, আমি তো ফিদেল কাস্ত্রো না, আমি আমার এলাকাটা সুন্দর করে রাখতে চাই।”
ভোট নয়, বিপ্লব?
সুমনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামে, তাদের বাড়িটি সৈয়দ বাড়ি নামেই পরিচিত। বাবা আর্শাদ আলী ছিলেন ব্যবসায়ী, মা গৃহিনী। পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট সুমনের লেখাপড়ার শুরু স্থানীয় স্কুলেই। ডিসিপি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর পাড়ি জমান রাজধানীতে, ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ে ভর্তি হন।
বিবিএ, এমবিএ করার পর কোনো চাকরি না খুঁজে স্বাধীন পেশা খুঁজে নিতে আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানে কষ্ট করে চলার কথা নানা সময়েই বলেছেন সুমন; জানিয়েছেন, গাড়ি চালিয়ে, ট্রলি ঠেলে তাকে অর্থ উপার্জন করতে হত।
ব্যারিস্টারি করে ফিরে আসেন দেশে, আইন পেশায় সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি সরব হন সোশাল মিডিয়ায়, তা থেকে রাজনীতিতে।
সুমনের এলাকা মাধবপুর ও চুনারুঘাট পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও সেখানে নানা সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা দেখা যায়, যদিও সেখানকার জনপ্রতিনিধি মাহবুব আলী বেসামারিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।
এলাকাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন সুমন। তিনি বলেন, “প্রাকৃতিকভাবে এটা পর্যটন এলাকা। এটাকে নারিশ করতে হবে। প্ল্যানমাফিক একটি ফাইভ স্টার হোটেল করতে হবে, চা বাগানগুলোকে সাজিয়ে তুলতে হবে, মেইন রোড গুলোকে সুন্দর করতে হবে।”
চা বাগানের শিশুরা যেন পড়াশোনা করে নিজের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পারে, সে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
ভোটারদের প্রত্যাশার একটি চাপ অনুভব করছেন সুমন, তবে তাতে উৎরে যাওয়ার বিষয়েও আশাবাদী তিনি।
“প্রত্যাশা পূরণের আত্মবিশ্বাস আমার রয়েছে। যদি আমি নেতা হই, সরকারের সব সময় আমাকে সাহায্য করা লাগবে, তা নয়। আমার নিজের ইনকাম আর আমার এলাকায় প্রভাবশালী ধনী যারা আছে, তাদের আমি উন্নয়ন যাত্রায় শামিল করতে চাই। সবাই যদি সম্মিলিতভাবে অংশীদার হয়ে যায়, তবে আমি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।”
ঘরে-বাইরে নানা আলোচনার মধ্যে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে এবং তাতে জয়ী হবেন বলে আশাবাদী সুমন।
“আমার বিশ্বাস, ফেয়ার নির্বচন হবে। আমার মনে হচ্ছে, আমার আসনে অনেক ভোটারের উপস্থিতি হবে। আমি তাদের বিশ্বাস করাতে পেরেছি; এটা ভোট নয়, বিপ্লব।”