প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আশঙ্কাই সত্যি হলো। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শেষ পর্যন্ত ‘নৌকা থেকে দোল খেয়ে পড়েই গেলেন’।
দলীয় প্রতীক মশালের পরিবর্তে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে এবারও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন জাসদপ্রধান। তবে তিনি প্রায় ২৪ হাজার ভোটে হেরে গেছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিনের কাছে, যিনি এই ভোটে অংশ নেওয়ার জন্য মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন।
জাসদপ্রধান ইনু এর আগে টানা তিন বার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হন এ আসনে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তীব্র বিরোধ আর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই এবার তার এমন পরাজয় বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও রাজনীতি সচেতন মানুষ।
শেখ হাসিনা গত ২৩ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে (সেখানে উপস্থিত ছিলেন হাসানুল হক ইনু) নির্বাচন নিয়ে এক ভার্চুয়াল সভায় বলেছিলেন, ‘ইনু ভাইও আমাদের নৌকায় উঠেছেন। খেয়াল রাখবেন তিনি যেন নৌকা থেকে দোল খেয়ে পড়ে না যান’।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন জাসদ সভাপতির এমন পরিণতির কথা। তাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইনুর পাশে থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা ইনুর।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে দলের নেতাকর্মীদের কোনো বাধা নেই- আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্তের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কুষ্টিয়া-২ আসনে ইনুর বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রার্থী হন কামারুল আরেফিন। প্রথমবারেই বাজিমাতও করেছেন এক সময়ের এই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এ আসনে কামারুল ট্রাক প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ ভোট, ইনু পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪৪৫ ভোট।
কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ-আওয়ামী লীগের ভোটের হিসাব
এ আসনে বিগত দিনের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাসদের তুলনায় আওয়ামী লীগের সমর্থন অনেক বেশি।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদে জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন ইনু। তার আগে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তিনি জাসদের মশাল প্রতীকে পান ৩৮ হাজার ৮৭৭ ভোট, যা আসনের মোট ভোটের ১৫.৪ শতাংশ। সেবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুবউল আলম হানিফ পান ৮৭ হাজার ৭৩৪ ভোট, যা মোট ভোটের ৩৪.৮ শতাংশ।
১৯৯৬ এর নির্বাচনে ইনু মশাল প্রতীকে পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ৩২৭ ভোট, যা মোট ভোটের ১৩.৫ ভাগ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও মশাল প্রতীকে লড়েন তিনি। পেয়েছিলেন ২১ হাজার ৪১১ ভোট, যা মোট ভোটারের ১৫.১ ভাগ। এ হিসাবে দেখা যায়, আসনটিতে জাসদের সর্মথন ১৬ শতাংশের কম। বর্তমানে এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৬২ জন।
ইনুর হার যেসব কারণে
নবম জাতীয় সংসদে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পারেননি দলের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তার বদলে হাসানুল হক ইনু জোটের প্রার্থী হয়ে প্রথমাবারের মতো এমপি হন। সেই থেকে সেখানে আওয়ামী লীগ-জাসদ দ্বন্দ্ব শুরু।
স্থানীয়রা বলছেন, কুষ্টিয়া-২ আসনে ইনু টানা তিনবার এমপি হলেও গত ১৫ বছরে ‘ক্ষমতার ভাগাভাগি’ নিয়ে আওয়ামী লীগ-জাসদ সমর্থকরা কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। এসব ঘটনায় প্রাণ গেছে অন্তত ৪ জনের। আর উভয় দলের নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ, রেষারেষি ছিল নিত্তনৈমিত্তিক।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর হাসানুল হক ইনু মিরপুর ফুটবল মাঠে এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “কারও দয়ায় মন্ত্রী হইনি (সে সময় তিনি তথ্যমন্ত্রী ছিলেন)। ঐক্য প্রশ্নে ১ টাকা চেনেন? ১০০ পয়সায় এক টাকা। আপনার ৮০ পয়সা থাকতে পারে। কিন্তু আপনি ১ টাকার মালিক না। আপনি ৮০ পয়সা আর রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়ুয়া, এরশাদ ও হাসানুল হক মিলে ১ টাকা হয়। আমরা যদি না থাকি তাহলে ৮০ পয়সা নিয়ে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবেন। হাজার বছরেও ক্ষমতার মুখ দেখবেন না।”
তারপর অনেক সময় গড়ালেও ইনুর সেই জ্বালাময়ী বক্তব্যের রেশ কাটেনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় আওয়ামী নেতারা ইনুর সেই বক্তব্য নতুন করে সামনে আনেন। মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা কামারুল আরেফিনের পক্ষে একাট্টা হন। কামারুলকে সমর্থন দেন বেশিরভাগ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও।
তাই গত তিন নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতাকে হাসানুল হক ইনুর প্রচার-প্রচারণায় দেখা গেলেও এবার ছিল ব্যতিক্রম। এবার তার সঙ্গে প্রচারে মিরপুর পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মেয়ার এনামুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আতাহার আলী, জেলা যুবলীগ সভাপতি রবিউল ইসলাম এবং ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দুই একজন নেতা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।
আগের নির্বাচনে ইনুর পাশে থাকা মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল হালিম, ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিকুল আলম চন্নু, সহসভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠু, সাধারণ সম্পাদক শামিমুল ইসলাম ছানাসহ অনেকেই এবার কামারুলকে সমর্থন দেন।
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চলাকালে এক সভায় ভেড়ামারা উপজেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান মিঠু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের ভোট নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা করবেন, এমন সুযোগ আর দেওয়া হবে না। তাই আমরা এক একজন নেতাকর্মী কামারুল হয়ে ভোটের মাঠে লড়ব। কামারুলই আমাদের প্রার্থী।”
ইনুর হারে দুই দলের এই বিরোধ সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরপুর-ভেড়ামারা আসনে টানা ১৫ বছর এমপি থেকেও দল গোছাতে পারেননি ইনু। জাসদের হাতে গোনা দুয়েকজন নেতা এই সময়ে সুবিধাভোগী ছিলেন। অন্যরা সব কিছু থেকে দূরে ছিলেন। এতে ১৫ বছরে স্থানীয় জাসদের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত হওয়ার চেয়ে নাজুক হয়েছে। এসবের প্রভাব শুধু কুষ্টিয়া-২ আসন নয়, জেলার অন্য আসনগুলোয়ও পড়েছে। জাসদ সাংগঠনিকভাবে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে, যার প্রভাব দেখা গেছে ইনুর এবারের ভোটের ফলাফলে।
এছাড়া, দীর্ঘ দিন সংসদ সদস্য থাকলেও হাসানুল হক ইনু তার আসনের দুটি উপজেলায় চোখে পড়ার মতো কোনও উন্নয়ন করতে পারেননি। যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। এলাকায় যে ধরনের উন্নয়ন কাজ আগে হয়েছে, ইনু তারচেয়ে বেশি কিছু করতে পারেননি। তার পরাজয়ের এটিও একটি কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে কুষ্টিয়া জেলা জাসদ সভাপতি গোলাম মহাসিনের দাবি, তাদের কোনও সাংগঠনিক দুর্বলতা নেই।
হাসানুল হক ইনু ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী ইনুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার বদলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ট্রাক প্রতীকে ভোট দেন।
“এছাড়া অন্তত ১৮টি কেন্দ্রে প্রশাসনের একাংশকে কাজে লাগিয়ে কারচুপি করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে কামারুলের ট্রাক প্রতীকে ব্যাপক জাল ভোট পড়েছে, এমনকি মৃত মানুষের ভোটও দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে ইনু পরাজিত হয়েছেন।”
হাসানুল হক ইনুও গণমাধ্যমকে প্রায় একই কথা বলেছেন। তার অভিযোগ, বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোট কারচুপির মাধ্যমে পরিকল্পিকভাবে তাকে হারানো হয়েছে।
তবে তার এই হারে ১৪ দলীয় জোটে কোনও প্রভাব পড়বে না বলেও জানিয়েছেন ইনু। তিনি বলেছেন, ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে শেখ হাসিনার সঙ্গে আগেই মতোই কাজ করে যাবে জাসদ।
ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমুল ইসলাম ছানা জাসদ নেতাদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সকাল-সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ভোট কারচুপির কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এখানে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। হাসানুল হক ইনু এমপি থাকাকালে তার প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যেভাবে খুন-নির্যাতন করা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে তার ফল পেয়েছেন তিনি।”
ইউপি চেয়ারম্যান থেকে জাতীয় সংসদে কামারুল
মেহেরপুর সরকারি কলেজে পড়ালেখার সময় কামারুল আরেফিন ছাত্রলীগের রাজনীতি জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯৩ সালে তিনি মিরপুর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৯৭ সালে সাধারণ সম্পাদব নির্বাচিত হন।
২০০৩ সালে যুবলীগ ছেড়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান কামারুল। ২০১২ সালে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সেই দায়িত্ব পালন করছেন।
এর মাঝে ২০১২ সালে তিনি সদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে ওই পদ ছেড়ে তিনি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। পরে দ্বিতীয় মেয়াদেও মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন কামারুল।
[জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া]