বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রীর একক ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি সংক্রান্ত আওয়ামী লীগের সময়ে করা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর দুটি ধারা-উপধারা অবৈধ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।
এ-সংক্রান্ত এক রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেয়।
রিটের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক; সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. তায়্যিব-উল-ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনজুর আলম।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রীর একক ক্ষমতা সংক্রান্ত ৬(২) উপধারা এবং দায়মুক্তি সংক্রান্ত ৯ ধারা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো সরকার এখন পুনর্মূল্যায়ন করতে পারব। যাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে এখন দরকষাকষি করতে পারবে। চুক্তির শর্তও বদলাতে পারবে।”
‘কুইক রেন্টাল’ আইন নামে পরিচিত এই আইনের ৯ ধারায় আদালতের এখতিয়ার রহিতকরণ বিষয়ে শাহদীন মালিক বলেন, “আদালত রায়ে বলেছে, এ ধরনের আইন সংবিধানের অধীনে হতে পারে না। আদালতে যেতে পারবে না, এমন দায়মুক্তি আইন করা যাবে না।”
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি পাস হয় ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর। জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে দরপত্র ছাড়াই প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ রাখা হয় এই আইনে।
এছাড়া এ আইনের আওতায় নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, সে বিধানও রাখা হয়। আইনটি সেসময় ‘দায়মুক্তি’ আইন হিসেবেও পরিচিতি পায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৮ আগস্ট আইনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে।
এরপর গত ২৭ আগস্ট এ আইনের ৬(২) উপধারা ও ৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক ও আইনজীবী মো. তায়্যিব-উল-ইসলাম।
এ দুটি ধারাকে সংবিধানের ৭, ২১, ২৬, ২৭, ৩১, ৪২, ৪৪, ৪৬, ১৪৩ ও ১৪৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করা হয় রিটে। গত ২ সেপ্টেম্বর রিটের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করে।
আইনে কী বলা আছে
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের প্রচার অংশে ৬(২) উপধারায় বলা হয়, “যা কিছুই থাকুক না কেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ধারা ৫ এ বর্ণিত প্রক্রিয়াকরণ কমিটি সীমিত সংখ্যক বা একক কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে উক্ত কাজের জন্য মনোনীত করে ধারা ৭ এ বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানোর পদক্ষেপ নেবে।”
আইনটিতে আদালতের এখতিয়ার রহিতকরণ অংশ ৯ ধারায় বলা হয়, “এই আইনের অধীনে কৃত বা কৃত বলে বিবেচিত কোনও কাজ, গৃহীত কোনও ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনও আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে আদালতের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।”
আইনজীবী কী বলছেন
আইনের ৬(২) উপধারার বিষয়ে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “মন্ত্রী কোনও দরপত্র ছাড়াই কোনও একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করতে পারেন। মন্ত্রী এককভাবে নিজের বিবেচনায় যেকারো সঙ্গেই চুক্তি করতে পারেন।
“আমরা জানি, আইন অনুযায়ী সরকারের ক্রয়-বিক্রয় একটি পাবলিক টেন্ডারের মাধ্যমে হয়। এখানে টেন্ডার ছাড়াই মন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তৎকালীন সরকার তাতে সম্মতিও জানায়।”
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(২) উপধারায় বেশ কিছু বিদ্যুৎ প্রকল্প হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কুইক রেন্টাল প্রজেক্টের বিশেষত্ব হলো, তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করুক বা না করুক, পুরো টাকা পাবে। অর্থাৎ ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সে ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে কিন্তু ১০০ মেগাওয়াটের টাকাই পাবে। এটা লুটপাটের বিশেষ বিধান আইন হয়ে গেছে।”
এই আইনের ৬(২) উপধারায় এক ব্যক্তিকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, “এটা কোনও প্রজাতন্ত্রে হতে পারে না। মূলত ৬(২) ধারার অধীনে বা পুরো আইনের অধীনে যে চুক্তি হচ্ছে, সেসব চুক্তির ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না, চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বা আদালতে মামলা করা যাবে না। অর্থাৎ আদালতের এখতিয়ারকে এ আইন বহিষ্কার করেছিল। এটা তো হতে পারে না।”
এ আইনে লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল মন্তব্য করে শাহদীন মালিক বলেন, “একজনের সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার একটি চুক্তি করা হলো। আরেকজনের সঙ্গে ১০০ কোটি টাকার আরেকটি চুক্তি করা হলো। আর তাদের বলা হলো, বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন বা না করেন, বিদ্যুতের সব পয়সা দেব। এটা তো লুটপাটের চরম ব্যবস্থা। এই আইনের মাধ্যমে লুটপাটকে আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।”
হাই কোর্ট বৃহস্পতিবারের রায়ে সরকারের প্রতি কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে জানিয়ে শাহদীন মালিক বলেন, “বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে সরকারি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে সেগুলো যাতে পুনরায় উৎপাদনে যেতে পারে, সে বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছে আদালত।”