স্পেন ২ : ১ ইংল্যান্ড
‘ইটস কামিং হোম’-বড় কোনও টুর্নামেন্ট এলে এটা হয়ে যায় ইংল্যান্ডের ফুটবলীয় সঙ্গীত। তবে শিরোপা আর আসে না। সেই ১৯৬৬-তে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোয় কোনও শিরোপা নেই তাদের। শিরোপা এলো না এবারও।
সৌন্দর্য্যের পসরা মেলে লাল সমুদ্রে পরিণত হওয়া বার্লিনে বিজয় কেতন ওড়াল স্পেন। ২-১ গোলে তাদের হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে জিতল রেকর্ড চতুর্থ শিরোপা। জার্মানির মাটিতেই পেছনে ফেলল জার্মািনির তিন শিরোপা জয়ের কীর্তি।
স্পেনের হয়ে একটি করে গোল নিকো উইলিয়ামস ও মিকেল ওইয়ারসাবালের। ইংল্যান্ডের হয়ে এক গোল ফিরিয়েছিলেন কোল পালমার।
২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ আর ২০১২ ইউরো জিতে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল স্পেন। সেই তারাই এরপর থেকে বড় টুর্নামেন্টগুলোতে পড়েছিল মুখ থুবড়ে। ২০১৬ ইউরো থেকে বিদায়ের পর স্প্যানিশ মিডিয়ার বড় অংশেরই মনে হয়েছিল ‘সব শেষ’। নতুন কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তের সেটা মনে হয়নি। তার হাত ধরে গত বছর উয়েফা নেশনস লিগের শিরোপা জিতে স্পেন। এবার লা রোজা খ্যাত দলটি ১২ বছর পর জিতল ইউরো।
হিটলারের তৈরি করা বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামকে লাল সমুদ্রই পরিণত করেছিলেন স্প্যানিশ ভক্তরা। আর মাঠে স্পেন ফুটিয়েছে পাসের ফুল। বাজিমাত করল তাতেই।
নিজের সব অর্জনের বিনিময়ে ইউরো জিততে চেয়েছিলেন হ্যারি কেইন। নিস্প্রভ থাকায় ৬০ মিনিটে সেই কেইনকে তুলে নিয়ে সেমিফাইনালের নায়ক ওলি ওয়াটকিনসকে নামান কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। স্পেনের বক্সে কেবল একবারই বল স্পর্শ করতে পেরেছিলেন কেইন!
বিপরীতে পাসের সঙ্গে গতি মিশিয়ে স্পেনের এই দলটা ছিল অনন্য। যেখানে একই সঙ্গে খেলেন ৩৮ বছরের জেসুস নাভাস আবার মাত্রই ১৭-তে পাওয়া দেয়া লেমিনে ইয়ামাল। খেলেন। ম্যানচেস্টার সিটিতে সফল রদ্রির পাশে আছেন চেলসিতে ব্যর্থ মার্ক কুকুরেয়া। তারকা না থাকাটা বাড়তি সুবিধা ছিল স্পেনের।
কুকুরেয়া ক্লাবে ব্যর্থ হলেও ইউরোজুড়ে রক্ষণে ছিলেন অসাধারণ। জার্মানির বিপক্ষে তার হাতে বল লাগার পরও পেনাল্টি দেননি রেফারি। সেই ক্ষোভে এরপর সব ম্যাচে কুকুরেয়ার পায়ে বল গেলেই দুয়ো দিয়েছেন জার্মান সমর্থকরা। ব্যতিক্রম ছিল না আজকের ফাইনালেও। এর মাঝেও নিজের কাজটা করে গেছেন এই ডিফেন্ডার। স্পেনের দ্বিতীয় গোলের অ্যাসিস্টটা তারই।
প্রথম ২০ মিনিটে বল পজেশনে এগিয়ে থাকলেও ভীতি ছড়ানো আক্রমণ শানাতে পারেনি স্পেন। বাম প্রান্তে নিকো উইলিয়ামসই এ সময় কাইল ওয়াকারের বিপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন আক্রমণের, যা ছিল স্পেনের ৫৩.৮ শতাংশ। আর লুক শ’র দৃঢ়তায় তো বিরতির আগে জাদুর ঝাঁপি বন্ধই ছিল লামিনে ইয়ামালের।
বিরতির আগে দুই দলই ছিল অতি সাবধানী, আগ্রাসি হয়নি কেউ। ৬৯.২ শতাংশ বলের দখল রেখে স্পেন পোস্টে ৫টা শট নিলেও গোল হওয়ার মত ছিল না সেগুলো। ইংল্যান্ডের ৩টি শটের মধ্যে লক্ষ্যে ছিল একটি। ইনজুরি টাইমে ফ্রিকিক থেকে কঠিন অ্যাঙ্গেলে বল পাওয়া ফিল ফোডেনের শট সঠিক জায়গায় থাকা গোলরক্ষক উনাই সিমনের ঠেকাতে বেগ পেতে হয়নি তেমন। বিরতির আগে স্পেনকে আটকে রাখতে পারাটা বড় সাফল্য ছিল লুক শ, কাইল ওয়াকারদের।
বিরতির পর আর পেরে উঠেনি ইংলিশ রক্ষণ। দানি কারভাহালের বুটের বাইরের অংশ দিয়ে করা ফ্লিকে বল পেয়েছিলেন লামিনে ইয়ামাল। তার পাস ফাঁকায় পাওয়া নিকো উইলিয়ামস ৪৭তম মিনিটে ঠান্ডা মাথায় পাঠান জালে। এবারের ইউরোয় এটা ছিল কদিন আগে ১৭ বছরে পা দেওয়া ইয়ামালের চতুর্থ অ্যাসিস্ট।
টুর্নামেন্ট জুড়ে দুই উইঙ্গার ইয়ামাল আর উইলিয়ামসের বোঝাপড়া বিপদ বাড়িয়েছে বিপক্ষের। ইংল্যান্ডও প্রথম গোলটা হজম করে দুজনের যুগলবন্দিতে। এজন্যই ইউরো শেষে উইলিয়ামসকে দলে আনতে মরিয়া বার্সেলোনা।
চোটের জন্য বিরতির পর রদ্রির উঠে যাওয়াটা বড় ধাক্কা ছিল স্পেনের। এজন্যই হয়ত আগ্রাসি হয়ে গোল আদায় করে স্বস্তিতে থাকতে চাইছিল তারা। ৪৯ মিনিটে নিকো উইলিয়ামসের পাস ভালো জায়গায় পেয়েও বাইরে মারেন দানি ওলমো। ৫৫ মিনিটে অবিশ্বাস্য মিস করেন আলভারো মোরাতা। ৫৬ মিনিটে ফাবিয়ান রুইজের কাছ থেকে বল পেয়ে বক্সের বাইরে থেকে বুলেট শট নেন উইলিয়ামস। অল্পের জন্য সেটা যায় বাইরে দিয়ে। ম্যাচে তখন পুরো স্প্যানিশ আধিপত্য।
৬৪ মিনিটে দারুণ টার্নে বলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে বক্সের বাইরে থেকে শট নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের পোস্টার বয় জুড বেলিংহাম। সেই শট যায় বাইরে দিয়ে। এর দুই মিনিট পর ব্যবধান প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলেছিলেন ইয়ামাল। ওলমোর পাসে বডি ডজে সামনে থাকা ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে ইয়ামাল নিচু শট নিলেও অসাধারণ সেভে ইংল্যান্ডের ত্রাতা গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড।
ইংল্যান্ড সমতায় ফিরে ৭৩ মিনিটে। বদলি হয়ে নামার তিন মিনিটের মাথায় গোল করেন কোল পালমার। বুকায়ো সাকা বক্সে ক্রস ফেলেছিলেন জুড বেলিংহামের জন্য। রিয়াল মাদ্রিদের এই তারকার কাছ থেকে বল পেয়ে ২২ গজ দূর থেকে নেওয়া শট জালে জড়ান পালমার। এই আক্রমণের শুরুটা করেছিলেন আবার গোলরক্ষক পিকফোর্ড। তাতেই স্পষ্ট দলীয় অসাধারণ সমন্বয়েরই গোল এটা।
পালমার গোল করলেন ২২ বছর ৬৯ দিনে। ইউরো ফাইনালে এত কম বয়সে বদলি হয়ে নেমে গোল পাননি আর কেউ।
এই গোলের পরই বদলে যায় মাঠের পরিবেশ। ইংলিশ সমর্থকরা গান গেয়ে উজ্জীবিত করছিলেন বেলিংহাম, পালমারদের। এরই মাঝে ৮২ মিনিটে দারুণ সুযোগ পেয়ে নষ্ট করেন ইয়ামাল। নিকো উইলিয়ামসের বাড়ানো পাসে ওয়ান টু ওয়ান পজিশনে পেয়েও পিকফোর্ডকে ফাঁকি দিতে পারেননি তিনি।
ইয়ামালের দুটি শট ঠেকালেও ৮৬ মিনিটে আর পারেননি পিকফোর্ড। কুকুরেয়ার নিচু ক্রসে পা ছুঁইয়ে স্পেনকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেন মিকেল ওইয়ারসাবাল। অল্পের জন্য অফসাইডের ফাঁদে পড়েননি তিনি।
৯০তম মিনিটে গোল প্রায় ফিরিয়েই দিচ্ছিল ইংল্যান্ড। কর্নার থেকে আসা বলে ডেকলান রিসের হেড ফেরান গোলরক্ষক। ফিরতি বলে মার্ক গুয়েহির প্রচেষ্টা হেডে ফেরান দানি ওলমো। এই সেভের পরই এক দফা উল্লাস করে নেন ওলমো। আর ম্যাচ শেষে তো চতুর্থ ইউরোর উচ্ছ্বাসে মাতে পুরো স্পেন।