কাকডাকা ভোরে মুঠোফোনের অন্যপ্রান্তে যখন কথা বলছেন, ততক্ষণে বিমানবন্দরে যাওয়ার তাড়া মোসাম্মৎ ইতি খাতুনের। জীবন কখন কিভাবে বাঁক বদল করে কেউ জানে না! বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে পদকমঞ্চে উঠে সোনা জয়ের কীর্তিগড়া আর্চার ইতি খাতুন এক সময় বিয়ের কারণেই খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই ইতি আবারও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিরলেন!
ঘরকন্নায় ব্যস্ত ইতির কোলজুড়ে এসেছে ছেলে সন্তান। ছেলে তৌফিক আবদুর রহমানের বয়স দুই বছর। সেই ছেলেকে চুয়াডাঙ্গায় মায়ের কাছে রেখে আবারও জাতীয় দলের ক্যাম্পে ফেরেন গত বছর অক্টোবরে। টানা সাড়ে তিন মাসের অনুশীলনের ফলে আবারও ফিরেছেন জাতীয় দলে। শুধু ফিরেছেনই না। জাতীয় দলের রিকার্ভ মেয়েদের ইভেন্টে এখন বড় ভরসার নাম ইতি।
প্রায় ছয় বছর পর জাতীয় দলে ফেরা ইতি রবিবার সকালের ফ্লাইটে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। যেখানে বাংলাদেশ খেলবে এশিয়া কাপ ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট স্টেজ ওয়ান। আগামী ১৬-২২ ফেব্রুয়ারি হবে এই প্রতিযোগিতা।
কি দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে আর্চারিতে আগমন ইতি খাতুনের! এসেই পারফরম্যান্স দিয়ে সবার নজর কাড়েন। এরপর ২০১৯ সালের এসএ গেমসে গড়েন বিরল কীর্তি। এসএ গেমসের ইতিহাসে এর আগে কোনও নারী খেলোয়াড় যা করেননি, সেটাই করে দেখান ইতি। একটি গেমসে নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনে ৩টি সোনা জিততে পারেননি কেউ। কিন্তু ২০১৯ সালের নেপালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে সেই কীর্তি গড়েন ইতি। জেতেন আর্চারির রিকার্ভ একক, দলগত ও মিশ্র ইভেন্টে সোনার পদক।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) প্রতিভা অন্বেষণের আবিষ্কার ইতি। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা স্টেডিয়ামে বাছাইয়ে প্রথম হন। এরপর ওই বছরেই পরিবারের অমতে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ইতিই কিনা ভালোবেসে বিয়ে করেন ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সাবেক সাঁতারু শাকিল পারভেজকে বিয়ে করেন ইতি। এরপর খেলাটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
জাতীয় দলে ইতির অভিষেক ২০১৮ সালের জাকার্তা এশিয়ান গেমস। কিন্তু ২০১৯ সালে এসএ গেমসে খেলার পর এভাবে ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন ভাবেননি। কিন্তু খেলা ছাড়লেও সব সময় ইতির মন পড়ে থাকতো আর্চারিতে।
যে কারণে ২০২৩ সালে আবারও জাতীয় দলে ফেরার চেষ্টা। কিন্তু তখন ছেলের বয়স ছিল মাত্র ৬ মাস। অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্ম দেওয়া ইতির জন্য তাই লড়াইটা বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু পারফরম্যান্স ভালো না থাকায় জাতীয় দলে ফেরা হয়নি। তারপরও নড়াইলে বাংলাদেশ পুলিশ দলের ক্যাম্পে কঠোর অনুশীলন চালিয়ে গেছেন।
বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের মেয়েদের রিকার্ভ ইভেন্ট একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাসরিন আক্তার চলে গেছেন জাতিসংঘ মিশনে। সম্প্রতি দিয়া সিদ্দিকীও যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হয়েছেন। সব মিলিয়ে তাই ইতির ওপর আস্থা রেখেছেন কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ।
ছেলেকে নিজের মায়ের কাছে রেখে ইতি চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তীর ধনুকের নিশানা ছোয়ার। থাইল্যান্ড যাওয়ার বিমানে ওঠার আগে সেই কথাই বলছিলেন, “আমি এখন প্র্যাকটিসে খুব ভালো পারফরম্যান্স করছি। কখনও হাল ছাড়িনি। চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল আবারও খেলায় ফিরব। এখন আমি ও আরেকজন নতুন মেয়ে (সোনালী) দলে খুব ভালো করছি। এশিয়া কাপ দিয়ে আমি নতুন করে শুরু করতে চাই। এ ব্যাপারে আমার পরিবার ও স্বামী যথেষ্ট সমর্থন করেন। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। আমি আর্চারিতে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে চাই। কারণ খেলাটা কখনও ছেড়ে দিইনি। নড়াইলে সবাই অনুশীলনে গিয়ে বসে থাকলেও আমি আলাদাভাবে প্র্যাকটিস করেছি। “
ইতি থাকেন টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে। এত দূরে ছেলেকে রেখে অনুশীলন করাটা চ্যালেঞ্জের। কষ্ট হয় জেনেও আর্চারির প্রতি ভালোবাসায় সেটা সয়ে অনুশীলন চালিয়ে যান ইতি, “ এভাবে অনুশীলন ক্যাম্পে থাকতে একটু কষ্ট হয়। কিন্তু যখন ছেলের কথা মনে পড়ে তখন স্যারেরা ছুটি দেন। আমাকে সবাই সাপোর্ট দেন।”
ফ্রেডরিখও খুশি ইতির পুনর্জন্মে। ইতি বলছিলেন, “এখন যে পরিস্থিতি তাতে স্যার অনেক খুশি। আমি চাই এশিয়া কাপে সোনা জিতে স্যার ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে।”
বাংলাদেশ আর্চারি দল
রিকার্ভ ইভেন্ট : সাগর ইসলাম, রামকৃষ্ণ সাহা, মোহাম্মদ রাকিব মিয়া, মোহাম্মদ মিসহাদ প্রধান, মোসাম্মৎ ইতি খাতুন, সোনালী রায়, সীমা আক্তার শিমু।
কম্পাউন্ড ইভেন্ট : নওয়াজ আহমেদ রাকিব, মোহাম্মদ সোহেল রানা, হিমু বাছার, বন্যা আক্তার, খুরশীদ জাহান, পুষ্পিতা জামান।
কোচ: মার্টিন ফ্রেডরিখ।