ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহাদেশটিতে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার এমন ঝুঁকি দেখা যায়নি।
সমারিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন ধীরে ধীরে, কিন্তু অনিবার্যভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারতে যাচ্ছে।
কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে এই হারিয়ে বা হেরে যাওয়ার মানে কী?
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো যোদ্ধা অবশিষ্ট নেই ইউক্রেনের। যুদ্ধে প্রতিদিন শত শত মানুষ হতাহত হচ্ছে। তীব্র লড়াইয়ের কারণে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোকে ‘মিট গ্রাইন্ডার’ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে।
মস্কোর প্রায় ৫ লাখের বেশি প্রশিক্ষিত যোদ্ধার বিশাল মজুত রয়েছে। এই সংখ্যা ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি। ইউক্রেনের এখন আর কোনও রিজার্ভ সৈন্য নেই বললেই চলে। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও, দেশটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজেই বারবার সমরাস্ত্র ও যোদ্ধা সংকটের কথা বলে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে সহায়তা চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ জেলেনস্কিকে সহায়তা করছেন সত্যি, কিন্তু এই সহায়তা ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে সহায়তা না করে উল্টো পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে বলে মনে করছেন অনেকে।
যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, এনিয়ে রাশিয়ার কৌশল এখনও অস্পষ্ট। কখনও কখনও মস্কো বলছে, তারা নিজেদের অঞ্চলকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করতে চাইছে।
তবে ইউক্রেনের ভেতরে নিপার নদীর কাছাকাছি রাশিয়ার জন্য বাফার জোন তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ ওই অঞ্চলটি উভয় দেশেরই দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইলের আওতার মধ্যে পড়ে। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, রাশিয়া বাফার জোন তৈরি করতে চাইছে জাপোরিঝিয়া ও ক্রিমিয়া থেকে হামলা পরিচালনার জন্য। কারণ এতে ইউক্রেনের বিশাল এলাকা রূশ ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আসে।
ন্যাটো এখন ইউক্রেনকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিমানগুলো রোমানিয়ার বিমানবন্দর থেকে পরিচালিত হবে। আর এই এগুলোকে দূরপাল্লার জেএএসএসএম ক্রুজ মিসাইল ও এআইএম-১২০ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইলে সজ্জিত করা হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাশিয়াকে কি রোমানিয়ার বিমানবন্দর থেকে পরিচালিত যুদ্ধবিমানের আক্রমণ ঠেকাতে সেখানে হামলা চালাতে হবে? নাকি, ন্যাটো ক্রিমিয়ায় আঘাত হানার জন্য রোমিনিয়ার বিমানবন্দর ব্যবহারের ধারণা থেকে সরে যাবে?
ক্রিমিয়া রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ইউক্রেন ক্রিমিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বিশেষ করে সেভাস্তোপোলের বিমান ও নৌ-বন্দরে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেন অচিরেই কের্চ সেতুতে ফের হামলা করতে পারে।
এসব হামলায় ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই দিয়েছে ন্যাটো। আর ন্যাটোর পরামর্শেই এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে ইউক্রেন। ন্যাটো ইউক্রেনের হয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থান চিহ্নিত করতে নিজেদের গুপ্তচর বিমান, দূরপাল্লার রাডার ও স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে।
ক্রিমিয়ায় আক্রমণের পেছনে ইউক্রেনের তেমন কোনও সামরিক উদ্দেশ্য নেই। কারণ, যুদ্ধের জন্য যে স্থলবাহিনী দরকার তা ইউক্রেনের নেই। কিন্তু রাশিয়াকে অপমানের জন্য চালানো আক্রমণ হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে বলেও মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ানো হলে, মস্কো তীব্র প্রতিক্রিয়াও জানাতে পারে। তারা খারকিভ, ওডেসা বা কিয়েভ আক্রমণ করতে পারে। এমনও হতে পারে যে, রাশিয়া একযোগে শহর তিনটিতে হামলা করে বসতে পারে।
ইউক্রেনকে ন্যাটো যত ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে পারে, তার চেয়েও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র আছে রাশিয়ার কাছে। কিয়েভের এসব ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও আর বেশি অবশিষ্ট নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেলে রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়া ছাড়া ন্যাটোর হাতে আর কী কৌশল থাকবে?
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ন্যাটো রায়িশাকে বোঝাতে চাইছে যে, তারা ইউক্রেনকে হারালে এজন্য চরম মূল্য দিতে হবে। ন্যাটোর অনেকেই মনে করেন, রাশিয়ার ভেতরে চাপ বাড়লে দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে যাবে। হয়তো যুদ্ধবিরতি চুক্তিও হতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাশিয়াকে ইউক্রেনে অভিযান বন্ধ করতে বা যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানোর কোনও কারণ নেই। যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনেক কথা হলেও, এতে রাশিয়ার চেয়ে বেশি লাভবান হবে ইউক্রেন।
রাশিয়া এরই মধ্যে কিউবায় যুদ্ধজাহাজ ও পারমাণবিক সাবমেরিন পাঠিয়ে নিজস্ব কায়দায় ওয়াশিংটনকে বার্তা পাঠিয়েছে। তবে এই বার্তা ওয়াশিংটন বুঝতে পারবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। যাই হোক, রাশিয়া তাদের ভূখণ্ডে ও ক্রিমিয়ায় হামলার জন্য ক্ষুব্ধ।
রাশিয়ার নেতৃত্বের মধ্যে আসল চাপ হলো ইউক্রেনের লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সংখ্যা বাড়ানো। সম্প্রতি সেন্ট পিটার্সবুর্গে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলনে হওয়া একাধিক বৈঠক থেকে এমন বার্তা পাওয়া গেছে।
পুতিন কিন্তু এমন কিছু বলেননি। অন্তত প্রকাশ্যে নয়। তবে পুতিনের অধীন নেতৃত্ব কিন্তু তাদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছিল। তারা ইউক্রেন ও ন্যাটোকে শিক্ষা দিতে চায়।
কিছু ইউরোপীয় নেতা নিজেদের দেশেই রাজনৈতিক সমর্থন হারাচ্ছেন। বিশেষ করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। নিজের অস্তিত্ব টেকাতে তিনি দেশে আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন। সাম্প্রতিক ইউরোপীয়ান নির্বাচনে ইউরোপে ডানপন্থী দলগুলোর ব্যাপক উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে এমন বাস্তবতায় ম্যাঁক্রোকে নিজের পক্ষে জনমত ফেরাতে রীতিমতো লড়াই করতে হতে পারে।
সৈন্য পাঠানো, যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র সরবরাহ করে ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপকে একটি বৃহত্তর যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র রোমানিয়ায় এফ-১৬ বিমানঘাঁটি ব্যবহার করার পেছনে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এটি ইউরোপে যুদ্ধ শুরু করার এবং বাইডেনের ডুবন্ত রাজনৈতিক ভাগ্যকে উদ্ধারের একটি উপায় হতে পারে।
বাইডেন হয়তো এসবের কিছুই জানেন না। তার হ্যান্ডলাররাই হয়তো তাদের বসকে বাঁচাতে নতুন কৌশল নিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। ফলে ইউরোপকে যুদ্ধে নামানোর নীতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ইউরোপের কিছু নেতা তাদের ক্ষমতা টেকাতে ইউরোপের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিতে ফেলছেন।
ইউরোপের জনগণ বড় যুদ্ধকে সমর্থন করে কি না—এমন কোনও জরিপ এখনও হয়নি। বরং মহাদেশটিতে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। অঞ্চলটির ডান, বাম ও মধ্যপন্থীরাও যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
ন্যাটো ইতিমধ্যেই বিপজ্জনকভাবে নিজেকে একটি আগ্রাসী জোটে পরিণত করেছে। ফলে জোটটি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যসূত্র : এশিয়া টাইমস।