বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির বিরুদ্ধে ৭ হাজার অভিযোগ। এর মধ্যে ১৫০টি অভিযোগের আংশিক অর্থ, ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোহাম্মদ রাসেল।
রবিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই টাকা পরিশোধ করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য অনুসারে, গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা ৫৪৩ কোটি টাকা।
তবে ২০২১ সালে রাসেল দম্পতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর র্যাব জানিয়েছিল, ইভ্যালির দেনা ১ হাজার কোটি টাকা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ইভ্যালির রাসেল বলেন, “আমি খুব একটা উৎফুল্ল না। মাত্র ১৫০ জনের পরিশোধ করতে পেরেছি। কিন্তু যেদিন সবার টাকা ফেরত দিতে পারব, সেদিন খুশি হব। কিন্তু আমি কথা দিতে পারি যদি ব্যবসা করতে পারি সবার টাকা ফেরত দিতে পারব।
“আমরা গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে বিগ ব্যাংক অফারের মাধ্যমে আবার শুরু করেছি। প্রথম দিনই আমাদের ৮০ হাজার অর্ডার এসেছে। এখন পর্যন্ত আমরা ৬৫ হাজার অর্ডারের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি। গত এক মাসে আমাদের আয় থেকে অফিস ভাড়া, বেতন পরিশোধ করার পর যা বাকি ছিল, তাই আমরা আজকে যাদের পাওনা আছে তাদের পরিশোধ করছি।”
ব্যবসার পদ্ধতিতে নতুনত্বে এসেছে দাবি করে রাসেল বলেন, “আমরা আর আগের স্টাইলে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্যবসা করছি না, বরং শুধুমাত্র ক্যাশ অন ডেলিভারি মেথডে পণ্য সরবরাহ করছি। আমাদের মার্চেন্টদের টাকাও আমাদের কাছে আসছে না, সেটা কুরিয়ার কোম্পানির কাছে যাচ্ছে।”
ইভ্যালিকে ‘প্রতারক’ মানতে নারাজ রাসেল। তিনি বলেন, “আমরা কোনও প্রতারণা করিনি। আমাদের ভুল হয়েছে, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এখন এগিয়ে যেতে চাই।”
কবে সব দেনা পরিশোধ করা হবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আজকে তো শুধু যারা অধিদপ্তরে অভিযোগ করেছে, তাদের কিছু জনের অর্থ নিষ্পত্তি হচ্ছে। অভিযোগ করেননি এমনও অনেকে আছেন। সবার টাকা আমরা দিব।
“কিন্তু একবারে দেওয়া সম্ভব না। আমাকে বেঁধে রাখলেও তা হবে না। আমরা ব্যবসা শুরু করেছি, আমরা যত দ্রুত সম্ভব সবার টাকা ফেরত দিব।”
মে মাস থেকে ইভ্যালি সব দেনা পরিশোধ করা শুরু করবে বলে জানান রাসেল।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, “ই-কমার্স সাইটকে আটকিয়ে রাখা যাবে না। এটি চলবেই।
“২০২০ সালের দিকে ই-কমার্স সাইটগুলোতে ধস নামার কারণ ছিল তখন কোনও গাইডলাইন ছিল না। আমরা এখন গাইডলাইন করেছি, সেই গাইডলাইন মোতাবেক ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে, এর বাইরে গেলে আমরা পদক্ষেপ নেব।”
তিনি আরও বলেন, “মো. রাসেল যখন ডিসেম্বরে আবার ব্যবসা শুরু করলেন, তখন আমরা তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেই। তখন তিনি আমাদের কাছে এসে প্ল্যান দেন- কীভাবে এই টাকা ফেরত দেবে তারা, সেই মোতাবেকই কাজ হচ্ছে।”
রাসেলকে জেলে রাখলে সমস্যার সমাধান হতো না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “রাসেল সাহেবকে যাবজ্জীবন শাস্তি দিলে তো ভোক্তারা টাকা ফেরত পেত না। তাকে আমরা ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছি, যাতে তিনি সবার পাওনা পরিশোধ করতে পারেন।”
তবে মাত্র ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করাকে কেন্দ্র করে এত বড় অনুষ্ঠান আয়োজন কেন—এ প্রশ্নের জবাবে ভোক্তার ডিজি বলেন, “আমরা তো এত মানুষকে ডাকি নাই। আমরা শুধু আমাদের গ্রুপে জানিয়েছি, আপনারা নিজ আগ্রহেই এসেছেন।”
ভোক্তাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “রিয়াজুল জান্নাত নামে একটি ফেসবুক পেইজ কিছুদিন আগে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জায়নামাজ, জমজমের পানি বিক্রি করছিলেন বেশি দামে। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি।
“অনেক ফেসবুক পেইজ আছে, যারা আমেরিকার ডায়মন্ড রিং বিক্রি করছেন মাত্র ৫০০ টাকায়। এসব ট্রেস করা কঠিন। আজকে আছে, কালকে পেজ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে প্রতারণার হাত থেকে বাচার জন্য।”
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ও ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম ফকির।
গ্রাহকদের দায়ের করা প্রতারণা মামলায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির তখনকার চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে আটক করে র্যাব।
এই দম্পতির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়াসহ নানা অভিযোগের কথা জানিয়েছিল র্যাব।
সব মামলায় জামিন লাভের পর গত ১৮ ডিসেম্বর রাসেল ছাড়া পান। তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন অবশ্য আগেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
২০২১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর র্যাব জানিয়েছিল, ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেলকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মুখপাত্র জনিয়েছিলেন, ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা; চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃতরা কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির আরও দায়-দেনা রয়েছে।
তবে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে রাসেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন, গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের কাছে তার প্রতিষ্ঠানের দেনা ৫৪৩ কোটি টাকা।
ইভ্যালি তিন বছর পরিচালনার পর পুঁজিবাজারে আসার পরিকল্পনা ছিল রাসেলের।