প্রতারণার মামলায় ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে আদালত। এর ফলে মামলাটির বিচার অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো।
সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম আরফাতুল রাকিবের আদালত এই আদেশ দেয়। একইসঙ্গে আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাদী পক্ষের আইনজীবী ইমরান হোসেন।
বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতারণার অভিযোগে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা তাহসানুল ইসলাম আল-আমীন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।
বাদীর অভিযোগ, ২০২১ সালের ২৭ মার্চ থেকে একই বছরের ৫ জুন পর্যন্ত দুইটি মোটরসাইকেল, একটি স্মার্ট ফোনসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ক্রয়বাবদ ২ লাখ ২০ হাজার ৯৮৫ টাকা পরিশোধ করেন বাদী। এই টাকার বিপরীতে বাদীকে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে আংশিক টাকা ফেরতের উদ্দেশ্যে ইভ্যালির কর্তৃপক্ষে সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি চেক দেওয়া হয়। তবে ওই চেক দিয়ে বাদী সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে কোনও টাকা তুলতে পারেননি। পরে চেকের টাকা না পেয়ে মামলার বাদী দণ্ডবিধি আইনে ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরুর পর গাড়ি, মোটরসাইকেল, আসবাবপত্র, স্মার্ট টিভি, ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিনের মতো পণ্য অর্ধেক দামে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে সাড়া ফেলে ইভ্যালি।
ই-কমার্স প্লাটফর্মটির চটকদার প্রচারের প্রলোভনে অনেকেই বিপুল অঙ্কের টাকা অগ্রিম দিয়ে পণ্যের অর্ডার করেছিলেন পরে বেশি দামে বিক্রি করে ভালো লাভের আশায়। কিন্তু মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও তাদের অনেকে পণ্য বুঝে পাননি। ইভ্যালি অগ্রিম হিসেবে নেওয়া টাকাও ফেরত দেয়নি।
এক পর্যায়ে ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারীদের কাছে কয়েকশ কোটি টাকার দায়ে পড়ে ইভ্যালি। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইভ্যালিসহ আরও বেশ কিছু ই-কমার্স কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিক্ষোভে নামে গ্রাহকরা।
পরবর্তী সময়ে বিতর্কিত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ইভ্যালির বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা পড়ে সাড়ে ৭ হাজার অভিযোগ।
গ্রাহকদের দায়ের করা প্রতারণা মামলায় ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিকালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির তখনকার চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে আটক করে র্যাব।
এই দম্পতির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়াসহ নানা অভিযোগের কথা জানিয়েছিল র্যাব।
সব মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাসেল ছাড়া পান। তার আগেই ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল স্ত্রী শামীমা নাসরিন অবশ্য জামিনে পান।
চলতি বছরের ৭ মার্চ ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফারাহ দিবা ছন্দার আদালত প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির রাসেল ও তার স্ত্রীর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেয়।
২০২১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর র্যাব জানিয়েছিল, ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেলকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মুখপাত্র জনিয়েছিলেন, ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়ায় ৪০৩ কোটি টাকা; চলতি সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকা, বিভিন্ন পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ২১৪ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহক ও কোম্পানির কাছে বকেয়া প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃতরা কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির আরও দায়-দেনা রয়েছে।
তবে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে রাসেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন, গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের কাছে তার প্রতিষ্ঠানের দেনা ৫৪৩ কোটি টাকা।
জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর রাসেল আবার ইভ্যালির কার্যক্রম শুরু করেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গত ১৯ মে ঢাকার কারওয়ান বাজারে তাদের কার্যালয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থ পরিশোধ বিষয়ে পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে।
সেই সভাতেও যোগ দিয়েছিলেন ইভ্যালির রাসেল। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইভ্যালিতে আবার গ্রাহকরা কেনাকাটা শুরু করেছেন। নতুন ব্যবসার মুনাফা থেকে পাওনাদারদের ৫০ লাখ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার তথ্য দিয়েছিলেন তিনি।
ইভ্যালি তিন বছর পরিচালনার পর পুঁজিবাজারে আসার পরিকল্পনা ছিল রাসেলের।