আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের অনিয়ম-দুর্নীতি অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র তিন-চার মাসে ঠিক করে দেবে- এটি উচ্চাশা বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এত হতাশ হবেন না, আর্থিক খাতে যা হয়েছে তা কল্পনাতীত।
শনিবার ‘প্রাইভেট সেক্টর আউটলুক : এক্সপেকটেশন অ্যান্ড প্রায়োরিটিজ’ শীর্ষক এক ব্যবসায় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজনে রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ব্যবসায়ী নেতারা দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ এ হাতেম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের বেশি সময় হয়ে গেল, কিন্তু এখনও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি।
এসময় তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মাহমুদ ফ্যাশনের ডিএমডি রাফি মাহমুদকে পেটানোর ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বিভিন্ন সংকটের কারণে ৯ অক্টোবর কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা কর হয়। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকের টাকা পেতে দেরি হবে বলে জানানো হয়।
“এরপর গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে পেছনে সেনাবাহিনীর ছয়টা গাড়ি নিয়ে কারখানার সামনে শ্রমিকরা তাকে নির্মমভাবে লাঞ্চিত ও মারধর করে।”
হাতেম বলেন, “অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। তাই দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।”
‘মামলার আসামি হওয়া এখন ব্যবসায়ীদের আরেকটি সমস্যা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গত সরকারের আমলে সরকারের সঙ্গে কোনও অনৈতিক কাজে যুক্ত ব্যক্তিকে আসামি করা হলে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এখন অনেক ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হচ্ছে, যারা আসলে কোনোভাবে অনৈতিক কাজে যুক্ত নয়।”
অনুষ্ঠানে গত সরকারের দুর্নীতির ব্যাপকতার চিত্র তুলে ধরেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে আমরা আশ্বস্ত করছি যে, আমরা চেষ্টা করছি।
“বিগত ১৫ বছরের দুর্নীতি (অন্তর্বর্তী সরকার) মাত্র তিন চার মাসে সব ঠিক করে দেবে—একটু বেশি উচ্চাশা হবে। এত হতাশ হবেন না, আর্থিক খাতে যা হয়েছে, তা কল্পনাতীত। তবে ক্ষয় হয়ে যেতে শুরু করা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে এবং আরও ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন হওয়া উচিত বেসরকারি খাতের নেতৃত্বাধীন উন্নয়ন, যেখানে বেসরকারি খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
“অর্থনৈতিক খাতে যেটা হয়েছে, সেটা অকল্পনীয়। ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার নিজের টাকা নিয়ে চলে যেত বা ১০ কোটি টাকার লোন ১৫ কোটি টাকা নিয়ে ৫ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি গাড়ীতে ব্যয় করল এটা…। কিন্তু সবার টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেল- এটা কেমন কথা হল?”
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা। কারণ, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোও স্থিতিশীল করা যায় না।
“তবে আমি বলব স্থিতিশীলতা এখন মোটামুটি কিছুটা আসছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, সেই ক্ষয় রোধ করা হয়েছে। এক্সটে ক্রলিংপেগ করে মোটামুটি একটু আসছে।”
“ক্রলিং পেগ করার পর অনেকে বলেছিল ডলার ৩০০-৪০০ টাকা হয়ে যাবে। শ্রীলংকা পাকিস্তনের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা বলেছি না এতো হবে না। কারণ, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রেজিলিয়েন্স সক্ষমতা লোকজনের আছে।”
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রাসঙ্গিক, এখন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ফরেক্স রিজার্ভ স্থিতিশীল করা হচ্ছে।
“বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিকের মতো সকল দাতাদের সঙ্গে আমরা বসেছি, আমরা খুব ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।”
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উন্নীত হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রাইভেট সেক্টরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, এটি ২০২৬ সালে উত্তরণের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে আমরা স্লো ট্রানজিশন (শ্লথ গতি) সিস্টেমে করতে চাই। মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, এমন লেবেল যেভাবে দেওয়া হচ্ছে, তা সেরকম নয়।
“আমরা তাড়াহুড়ো করছি না, শ্লথ গতিতে হলে এর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আপনাকে খুব প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার, আন্তর্জাতিক সংযোগ, ব্যবসা সহজীকরণ, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাঠামো এবং সরকারের নীতি সহায়তা যুগোপযোগী করতে হবে।”
নতুন টাকা ছাপানোর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “টাকা তো বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাপাতে হবেই। নতুন টাকা ছাপানো নিয়ে গণমাধ্যম লিখেছে। নো দ্যাটস নট ট্রু। অনেক টাকা নষ্ট হয়ে যায়, সেই টাকা রিপ্লেস করব। বাকি যে টাকাটা আসবে, সেটা এম-১ এ যুক্ত করা হবে।
“টাকা মুদ্রণ, নতুন মুদ্রিত অর্থ রিসিভ এমনিতে যোগ হবে না। আমরা মনে করি যে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কোনোভাবেই হ্রাস পাবে না। আমরা বলেছি এবং আমরা মনে করি কোনোক্রমেই যেন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ না কমে। এখন কিছুটা কম। যেটা কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলেছে।”
“আমরা চেষ্টা করব ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র মাঝারি আর বড়দের তো বন্ধ করা যাবে না। আর সুদ হার যেন আর না বাড়ানো হয়।”
চলমান বিভিন্ন সংস্কারের বিষয় উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, “সংস্কার কার্যকরের মাধ্যমে আমরা পরবর্তী সরকারের কাছে একটি পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই, যাতে পরবর্তী সরকার আমাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করেন।”
অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “দেশের আইন-শৃংঙ্খলা ঠিক রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক আন্তরিক। আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আমাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন, আপনিও যুক্ত হোন।
“সরকার এ ধরনের নৈরাজ্য দেখতে চায় না। আমি নিশ্চিত আপনি পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নতি দেখতে পাবেন এবং সামনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয় আমাদের এতগুলো মন্ত্রণালয়ের দরকার নেই। একইভাবে এতোগুলো ব্যবসায়িক অ্যাসোসিয়েশনের দরকার নেই।
“আমি পারসোনালি মনে করি, মন্ত্রণালয় কমাই ফেলানো উচিত। উল্লেখযোগ্যভাবে কমাই ফেলানো উচিত। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় একীভূত করা উচিত। আমার মনে হয়, অ্যাসোসিয়েশনগুলোকেও মার্জ করা উচিত। এতে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।”
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে সুযোগের চেয়ে চ্যালেঞ্জ বেশি দেখছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আমি স্বল্পোন্নত দেশগুলির গ্রাজ্যুয়েশনের বিষয়ে সুযোগের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ দেখি। ২০২৬ বা ২০৩০ এটি একটি আলোচনা হতে পারে, কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমাদের উত্তরণ হতে হবে।”
“আমরা কি প্রস্তুত হতে পারি, হ্যাঁ, আমাদের বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার সাথে এই ধরনের আলোচনা করা দরকার” বলেন বশিরউদ্দীন।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক সমস্যাগুলো উল্লেখ করে বলেন, “বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না এবং খেলাপির সংখ্যা বাড়বে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্বিবেচনা করা উচিত।”