ঢাকার ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে এক ব্যাক্তির মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার প্রমাণ মিললেও দায়ী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
মৃত ব্যক্তির নাম রাহিব রেজা। তিনি স্টার্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে প্রোডাক্ট ম্যানেজার ও আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বুধবার হাইকোর্টে এক সংবাদ সম্মেলনে রাহিব রেজার পরিবারের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম অভিযুক্ত চিকিৎসক ড. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। এসময় রাহিবের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ডা. স্বপ্নীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান।
রাশনা ইমাম বলেন, ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে চিঠিও দেয় অধিদপ্তর। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি দুই প্রতিষ্ঠান।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পেটে গ্যাসজনিত সমস্যা নিয় ডা. স্বপ্নীলের কাছে যান রাহিব, তিনি এন্ডোস্কপি করার পরামর্শ দেন। সেদিন সন্ধ্যায় রাহিব ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালের বহির্বিভাগে যান এন্ডোসকপি করাতে। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তার পরীক্ষা শুরু হয়। এর প্রায় দেড়ঘণ্টা পর রাহিবকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান তার সঙ্গে যাওয়া সহকর্মী।
রাহিবের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাকে হাসপাতালটির আইসিইউতে নেওয়া হয়। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে রাহিবের পরিবার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ঝড় ওঠে। রাহিবের পরিবারের অভিযোগ, দায়িত্বরত চিকিৎসক ও টিমের গাফিলতির কারণে সাধারণ একটা অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে রাহিবকে। যার দায় ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
সেসময় দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
পরে আদালতে যায় রাহিবের পরিবার। ১১ মার্চ আদালত রুল জারি করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া ঞয়। ছয় মাস তদন্ত শেষে গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে অধিদপ্তরের কমিটি। যেখানে চিকিৎসায় গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনটির একটি কপি সকাল সন্ধ্যার হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, গত ২৪ জুন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব স্নেহাশীষ দাশের সই করা চিঠিতে ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
সেখানে বলা হয়, “ল্যাব এইড হাসপাতালের চিকিৎসক প্রফেসর মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে রাহিব রেজার এন্ডোসকপিকালীন মৃত্যুর অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে চিকিৎসা সেবা প্রদানে অবহেলার কারণে অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের বিরুত্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, “চিকিৎসায় অবহেলার ঘটনা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিবাদে আমরা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছিলাম। একই সঙ্গে বেশকিছু নির্দেশনা চেয়েছিলাম। আমাদের দাবি ছিল, চিকিৎসায় অবহেলা হয়েছে কিনা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা। সে আলোকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তদন্ত করেছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি স্পষ্টিকরণ (ক্লারিফিকেশন) চিঠিও দিয়েছে অধিদপ্তর। যেখানে স্পষ্ট করে ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, এন্ডোস্কোপির প্রক্রিয়া, এন্ডোস্কোপিকালীন এবং পরবর্তী স্টেজেও চিকিৎসায় চরম অবহেলা করা হয়েছে। রাহিব রেজা সর্বোচ্চ ঝুঁকির রোগী ছিলেন। অতিরিক্ত ওজন, কার্ডিয়াক ইস্যুও ছিল। অস্ত্রোপচারের আগে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে সেখানেই এসব শনাক্ত হয়।
“কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, ওনারা কোনো রিপোর্টই দেখেনি। ফলে কোনও ঝুঁকি আছে কিনা না জানায় কমানোর জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এর মধ্যেই এনেসথেশিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।”
তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “সেখানে দক্ষ কোনও এনেসথেশিওলজিস্ট ছিল না। এটা অবাক করে দিচ্ছে। এত বড় হাসপাতালে, এত বড় একজন ডাক্তার, তার টিমে কোনও দক্ষ এনেসথেশিওলজিস্ট নেই! কোনও ঝুঁকি যাচাই ছাড়াই এন্ডোস্কোপি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এন্ডোস্কোপিতে সম্পৃক্ত আট জনের সাত জনেরই অভিজ্ঞতার কোনও কাগজ তদন্ত কমিটি পায়নি। অর্থাৎ অদক্ষ লোক দিয়ে এন্ডোস্কোপি করানো হয়েছে।
“এখানে ডা. স্বপ্নীল ও হাসপাতাল উভয় সমান অপরাধী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, একই দিনে একই ডাক্তার আরও ৬৬টি এন্ডোস্কোপি ও কলোনস্কোপি করেছেন। এ ঘটনার পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরিদর্শনে গিয়ে একদিনে ৭১টি এন্ডোস্কোপি করার প্রমাণ পান।”
প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, “সেখানে বলা হয়েছে, এন্ডোস্কোপির পর রোগীর শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে ৮৫ মিনিট ধরে সময় নষ্ট করা হয়েছে। ফলে রোগীকে পরে আইসিইউতে নিলেও বাঁচানো যায়নি।”
তদন্তের পর অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএমডিসিকে চিঠি দিয়েছিল জানিয়ে রাশনা বলেন, “কিন্তু এখনও সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এজন্য আমরা আদালতের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন জানাব। একইভাবে বিএসএমএমইউকেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। তারও কিছু নেয়নি। এখন আমরা হাইকোর্টে ডা. স্বপ্নীলের নিবন্ধন বাতিল, ল্যাব এইডের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা এবং ক্ষতিপূরণ চাইব।”
অভিযোগ ও শাস্তির বিষয়ে ডা. স্বপ্নীলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।