“আমার বুকের মানিকটারে সারা রাত ধইরা অত্যাচার করছে। মাইরা হাত-পা ভাইঙ্গা ফালাইছে। ঘুষি দিয়া বাম চোখটাও নষ্ট করছে। এত অত্যাচার আমার মানিকটা সহ্য করতে পারে নাই, তাই দুনিয়াই ছাইড়া চইলা গ্যাছে। ও ভাই আমি এর বিচার চাই। বাপ হইয়া আমার বুকের মানিকরে যে এত কষ্ট দিল, তার বিচার চাই।”
নিজের একমাত্র ছেলে জুবায়েরকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে সকাল সন্ধ্যাকে এসব কথা বলছিলেন জোবেদা বেগম। তখন তার একটু দূরেই ৮ বছর বয়সী জুবায়েরের দাফনের প্রস্তুতি সারছিল এলাকাবাসী ও স্বজনরা।
শুক্রবার বিকালে ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের পলাশনগরে জোবেদার ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায় শোকে বিহ্বল সবাই। বিলাপ করতে থাকা জোবেদাকে ঘিরে আছে স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তারা তাকে নানা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু বিলাপ থামে না জোবেদার।
পুলিশ জানিয়েছে, জোবেদা গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার বাসার কিছুটা দূরে আরেক বাসায় ভাড়া থাকেন তার সাবেক স্বামী রিকশাচালক সেলিম মিয়া। তিনি মাদকাসক্ত। বুধবার বিকালে তিনি কৌশলে ছেলে জুবায়ের ও সাবেক স্ত্রীকে (জোবেদা) বাসায় নিয়ে যান। সে বাসায় ঝগড়া হয় জোবেদার সঙ্গে। এক পর্যায়ে ছেলেকে আটকে রেখে জোবেদাকে বাসা থেকে বের করে দেন সেলিম।
পুলিশ বলছে, পরে সাবেক স্ত্রী জোবেদার ওপর জিদ করে রাতভর নির্যাতন চালান ছেলের ওপর। বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিছুক্ষণ পর মারা যায় জুবায়ের। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সেলিম মিয়াকে আটক করে পল্লবী থানা পুলিশ।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই জোবেদা বেগম বাদী হয়ে তার সাবেক স্বামী সেলিম মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
স্বজনরা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে স্বামী সেলিম মিয়ার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় জোবেদার। এরপর থেকে তিনি মিরপুর ১১ নম্বরে আলাদা বাসায় থাকতেন একমাত্র ছেলে জুবায়েরকে নিয়ে। মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে বড় করছিলেন জোবেদা। আদরের সেই সন্তানকে হত্যা করেছে তার সাবেক স্বামী। সব মিলে এখন দিশেহারা জোবেদা।
ছেলের শোকে কাতর জোবেদা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বুধবার বিকালে ছেলেকে নিয়া ভাইয়ের বাসায় যাইতেছিলাম। এসময় রিকশা নিয়া আমাগো পথ আটকায় সেলিম মিয়া। পরে ছেলেকে আদর করার কথা কাইয়া আমাগো তার বাসায় নিয়া যায়।
“বাসায় যাওয়ার পর আমারে শারীরিক সম্পর্কের কথা বলে সেলিম। কিন্তু তালাক হওয়ার কারণে তার কথায় আমি রাজি হইনি। এসময় আমারে চড়-থাপ্পর মারা শুরু করে সেলিম। সেটা দেইখা আমার ফোন থেইকা ছেলে তার মামারে ফোন দেয়।”
জোবদা বলেন, “সেই ফোনটাই আমার ছেলের জন্য কাল হইয়া যায়। এই রাগে সেলিম পোলারে রাইখা আমারে ঘর থাইকা বাইর কইরা দেয়। এরপর পোলারে সারা রাত ধইরা মারছে। মোচড়াইয়া হাত-পা ভাইঙ্গা ফেলছে। তাছাড়া সারা শরীরে খালি মাইরের দাগ। পরে লোকজন হাসপাতালে নিলেও আমার পোলা আর বাঁচেনি। আমি এখন কী নিয়া বাঁচমু।”
জোবেদার অভিযোগ, সেলিম মিয়া মাদকাসক্ত। মাদক গ্রহণ করে প্রায়ই জোবেদাকে শারীরিক নির্যাতন করতেন। এ কারণেই তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় বছর তিনেক আগে।
জুবায়েরের মামাতো বোন মুন্নি জানান, তাকে মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের শিশু কবরস্থানে দাফন করা হবে।
মুন্নি বলেন, “জুবায়েরকে হত্যার পর পুলিশ সেলিম মিয়াকে ধরলে সে পুলিশের সামনেই জোবেদাকে হুমকি দিয়েছে। বলেছে, জেল থেকে ছাড়া পাইলে জোবেদাকেও খুন করবে। আমরা এই পাষণ্ড বাবার বিচার চাই।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মাদকাসক্ত সেলিম মিয়া শিশুটিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে ও মুচড়ে শিশুটির হাত-পা ভেঙে ফেলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বিষয়টি জানাজানি হলে প্রতিবেশীদের চাপের মুখে বৃহস্পতিবার সকালে সেলিম তার সন্তানকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জুবায়েরের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সেলিম মিয়াকে আটক করি।”
পরে জুবায়েরের মরদেহ উদ্ধার করে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।