পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হয়েছিল, সরকার পরিবর্তনের পর তা বদলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমে যে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছিল তাও সংশোধন হচ্ছে।
আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে নতুন সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রক্রিয়া খোলনলচে বদলে দিয়ে ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। এক বছরের মধ্যে তা এখন বদলে আগের অবস্থায় ফেরত নেওয়া হচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নতুন শিক্ষাক্রম থেকে পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার আলাপ তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই পরিবর্তন হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের ওপর তা চাপ হয়ে না দাঁড়ায়।
সেই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দিকভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে রবিবার তার একটি নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
তাতে বলা হয়েছে, এখন যে পাঠ্যবইগুলো শিক্ষার্থীরা পড়ছে, এই বছর তাই পড়ে যাবে, তবে মূল্যায়ন হবে আগের মতো পরীক্ষার মাধ্যমে। ২০২৫ সালে বই পরিবর্তন হবে।
প্রাথমিক : প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোর পাণ্ডুলিপি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে মুদ্রণ করা হবে। পাঠদান পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার পবির্তন হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতি যতদূর সম্ভব ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের মতো হবে।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে এবছর বই না বদলালেও পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে, যা বর্তমান শিক্ষাক্রমে ছিল না।
মাধ্যমিক : ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম ও ৯ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক এখন যা আছে, শিক্ষার্থীরা এবছর সেটাই পড়বে। ২০২৫ সালে সংশোধিত ও পরিমার্জিত বই পাবে তারা।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন অর্ধেক নেওয়ার পর আটকে গিয়েছিল আন্দোলনের কারণে। তা আর নেওয়া হবে না।
ডিসেম্বরে আগের মতোই ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা হবে। সেই মূল্যায়ন পদ্ধতির রূপরেখা শিগগিরই বিদ্যালয়গুলোকে জানিয়ে দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বিভাগ ফিরছে : ২০২৫ সালে যারা দশম শ্রেণীতে উঠবে, তাদের জন্য আগের মতো বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে। এজন্য ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বা পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে। এক বছর পর তারা সেই পাঠ্যসূচি ধরে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ সালে ৯ম শ্রেণীতে উঠবে, তাদেরও ২০১২ সালের অর্থাৎ আগের শিক্ষাক্রম অনুসারে বই দেওয়া হবে, সেই বই পড়ে তারা এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা হবে এবং ২০২৬ সাল থেকে তা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর বই, পাঠদানের প্রক্রিয়া, মূল্যায়ন সব পদ্ধতিই বদলে গিয়েছিল। তার পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনাও চলছিল।
সেই শিক্ষাক্রমে, প্রাক-প্রাথমিক স্তর, অর্থাৎ নার্সারি ও প্লে-তে শিশুদের জন্য কোনও নির্ধারিত বই নেই। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরাই তাদেরকে সরাসরি শেখান।
এরপর প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি বই থাকলেও কোনও পরীক্ষা নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছিল বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের দক্ষতা, উপস্থাপন, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজসহ বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার কর হয়।
এই শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১০টি বিষয়ে পড়ানো হচ্ছিল। সেগুলো হচ্ছে- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে আওয়ামী লীগ সরকারের যুক্তি ছিল, ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ এই শিক্ষাব্যবস্থা সচল হলে একজন শিক্ষার্থী সৎ, উদ্যমী, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন, অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার পরিচয় বহন করে যেমন ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে, তেমনি অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবন করার দক্ষতা অর্জন করবে। ফলে শিক্ষার্থীরা সূক্ষ্ম চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সবার জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এছাড়া এই শিক্ষাক্রম অনুসরণে শিক্ষার্থীরা যেমন নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হবে, তেমন গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করে বিশ্ব নাগরিকের ভূমিকা পালন করবে বলে আশা দেখিয়েছিল বিগত সরকার।
সেই শিক্ষাক্রম থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন যুক্তি দেখাচ্ছে, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব রয়েছে। পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কেও অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ফলে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়।