Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

‘হাসিমুখে ঢুকেছিলাম সারদায়, বের হলাম কাঁদতে কাঁদতে’

সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে পাসিং আউট প্যারেডে পুলিশ সদস্যরা। ফাইল ছবি
সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে পাসিং আউট প্যারেডে পুলিশ সদস্যরা। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

“গত বছরের ৪ নভেম্বর এসআই ক্যাডেটের ট্রেনিংয়ের জন্য হাসিমুখে সারদার পুলিশ একাডেমিতে ঢুকেছিলাম। ঠিক এক বছর পর আজ সারদা থেকে বের হলাম কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু জানতে পারলাম না কী অপরাধে নিজেও কাঁদলাম, পরিবারকেও কাঁদালাম।” 

সোমবার (৪ নভেম্বর) বিকালে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সারদা পুলিশ একাডেমির প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)।

এদিন দুপুরে তাকেসহ ৪০তম এসআই ক্যাডেট ব্যাচের ৫৮ জনকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি আরও বলেন, “আজ দুপুরে অব্যাহতিপত্র দেওয়ার সময় একাডেমির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের সামনেও আসেননি। এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এসে অব্যাহতিপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে সারদা থেকে বের করে দিল।”

এর আগে একই অভিযোগে গত ২১ অক্টোবর ৪০তম এসআই ক্যাডেট ব্যাচের আরও ২৫২ জন প্রশিক্ষণরত এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।  

৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসাবে এক বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল গত বছরের ৫ নভেম্বর। সেই হিসাবে ৪ নভেম্বর সোমবারই ছিল তাদের প্রশিক্ষণের শেষ দিন। প্রশিক্ষণ শেষে এই মাসেই তাদের চাকরিতে যোগদানের কথা ছিল।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এসআই পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় এই নিয়োগ হয়েছে অভিযোগ করে তা বাতিলের দাবি জানায় দলটি। বিএনপি এই দাবি তোলার পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে দুই ধাপে ৩১০ জন প্রশিক্ষণরত এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে অব্যাহতি পাওয়া আরেক ক্যাডেট এসআই সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আজ আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে কথা ছিল কাজে যোগ দেওয়ার। অথচ যে দিনটি আমাদের জন্য আনন্দের হওয়ার কথা ছিল, সেই দিনেই চোখের জলে ভাসানো হলো আমাদের।”

তিনি বলেন, “গত ৩৬৫ দিন ধরে প্রশিক্ষণে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছি। রোদ-বৃষ্টি কোনও কিছুই প্রশিক্ষণ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। কিন্তু সারা বছরের পরিশ্রম বৃথা গেল মিথ্যা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে। এই অন্যায়ের বিচার কার কাছে দেব জানি না।”

অব্যাহতি পাওয়া আরেক ক্যাডেট এসআই জানান, ২০২৩ সালে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে সেই চাকরিতে যোগদান করেননি।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “ব্যাংকের চাকরিও ছাড়লাম, পুলিশের চাকরিও গেল। এখন আমার ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না।”

৫৮ প্রশিক্ষণরত এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণেই তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির কারণ দেখিয়ে সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত ২৫২ ক্যাডেট এসআইকে গত ২১ অক্টোবর অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ২১ ও ২৪ অক্টোবর দুই দফায় ৫৯ জনকে শোকজ লেটার দেওয়ার কথা জানায় সারদা পুলিশ একাডেমি।

তবে সোমবার অব্যাহতিপত্র পাওয়া প্রশিক্ষণার্থীরা জানিয়েছেন, ৫৯ জন নয়, ৫৮ জনকে শোকজ লেটার দেওয়া হয়েছিল। একজনের নাম দুবার আসায় ৫৯ জন বলা হয়েছিল। প্রকৃত সংখ্যা ৫৮ হবে।

সোমবার দেওয়া অব্যাহতিপত্রে বলা হয়েছে, “আপনি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, রাজশাহীতে ৪০তম ক্যাডেট এসআই/২০২৩ ব্যাচে গত ৫/১১/২০২৩ খ্রিঃ হতে এক বছর মেয়াদি মৌলিক প্রশিক্ষণরত আছেন।

“গত ১৬ অক্টোবর জিমনেসিয়ামে সন্ধ্যাকালীন ক্লাসে ক্যাডেট এসআইদের “Experience Sharing in Order to face Political Aimed” বিষয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির সাবেক প্রিন্সিপাল মো. নাজিবুর রহমান, এনডিসি মহোদয়ের ক্লাস ছিল। উক্ত ক্লাসে ক্যাডেট এসআই প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিথি বক্তার সহযোগী প্রশিক্ষক হিসেবে পুলিশ পরিদর্শক শিশির কুমার চক্রবর্তী, মো. আব্দুল বারী, মো. মাহাবুব উল্লাহ ও রাজিব কুমার কুন্ডু উপস্থিত ছিলেন।

“অতিথি বক্তা ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে সিটে বসার সময় আপনি শৃঙ্খলার সাথে না বসে এলোমেলোভাবে বসে হৈ চৈ করতঃ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।

“এসময় পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) শিশির কুমার চক্রবর্তীসহ তার সঙ্গীয় অন্যান্য ইন্সপেক্টরগণ বারংবার শৃঙ্খলার সাথে বসার কথা বললেও আপনি উপস্থিত সহযোগী প্রশিক্ষকদের নির্দেশ অমান্য ও কর্ণপাত না করে বসা নিয়ে হৈ চৈ ও বিশৃঙ্খলা করতে থাকেন।”

অব্যাহতিপত্রে আরও বলা হয়, “ক্লাস চলাকালীন অতিথি বক্তার পাঠদানে আপনার কোন মনোযোগ ছিল না এবং পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলতে থাকেন। ক্লাসে আপনার এই ধরনের শৃঙ্খলা বিরোধী আচরণ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির নিয়ম শৃঙ্খলার পরিপন্থী মর্মে জনাব শিশির কুমার চক্রবর্তী (বিপি-৮০০৮১২০৩২৫) পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ), প্রিন্সিপাল (অতিরিক্ত আইজিপি), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, রাজশাহী বরাবরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

“উপরোক্ত অভিযোগের কারণে বিপিএ স্মারক নং- বিপিএ/বেসিক ট্রেনিং-২/ক্যাডেট এসআই-৪০/শৃংঙ্খলা/৫৪৩ তারিখ- ২১/১০/২০২৪ খ্রিঃ মূলে মাননীয় প্রিন্সিপাল মহোদয়ের পথে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিকস) ০৩ (তিন) দিনের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

“বর্ণিত নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আপনি নির্ধারিত ০৩ (তিন) দিন সময়ের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করেন। আপনার দাখিলকৃত কৈফিয়তের জবাব পর্যালোচনান্তে সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতিয়মান হয়।

বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদার প্রিন্সিপাল (অ্যাডিশনাল আইজিপি) মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা স্বাক্ষরিত অব্যাহতিপত্রে আরও বলা হয়েছে, “একজন প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে আপনার এ ধরনের আচরণ চরম শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও অসদাচরণের সামিল। আপনার উপরোক্ত শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ হিসেবে বিবেচিত সাব-ইন্সপেক্টর পদে কাজ করার পথে বড় ধরনের অন্তরায় ও অযোগ্যতার সামিল।”

“এমতাবস্থায় প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআই (অব্যাহতি পাওয়া ক্যাডেটের নাম) এর এহেন শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যক্রমের কারণে PRB-1943 এর বিধি 741-11] উপবিধি ৮ (111) মোতাবেক চলমান মৌলিক প্রশিক্ষণ হতে অদ্য ০৩/১১/২০২৪ খ্রিঃ অপরাহ্নে ডিসচার্জ (Discharge) করা হলো।”

তবে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে প্রশিক্ষণরত ৫৮ ক্যাডেট এসআইকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও গত ২১ অক্টোবর এদের মধ্যে যে ১০ জনকে শোকজ করা হয়েছিল, তাদের প্রশিক্ষক পুলিশ একাডেমির সাবেক প্রিন্সিপাল মো. নাজিবুর রহমান সকাল সন্ধ্যার কাছে দাবি করেছেন, তার ক্লাসে বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত