Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

এক্সিম-পদ্মা মিলবে কীভাবে? মিললে কী হবে?

এক্সিম ব্যাংকে একীভূত হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।
এক্সিম ব্যাংকে একীভূত হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।

দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার আলোচনার মধ্যেই সংকটে থাকা পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল শরিয়াভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক।

একীভূত হওয়ার বিষয়ে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক দুটির মধ্যে আগামী সোমবার একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হবে।

দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগের পর দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত।

এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে, যেখানে উপস্থিত থাকবেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খারাপ ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। এধরনের একীভূতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়। ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ধসে পড়া কয়েকটি ব্যাংককে কিনে নিয়েছে সবল কয়েকটি ব্যাংক।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক একীভূতকরণ সাধারণ ঘটনা নয়।

কেন একীভূত হচ্ছে?

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সংকটে পড়ার মধ্যে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে সবল ব্যাংকের একীভূত করার আলোচনা চলছিল।

নজরুল ইসলাম মজুমদার।

গত ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে।

এই সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে, এমন কথাও বলেন তিনি।

এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংককে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুরও পরামর্শ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই ধারায় তারা একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ আছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে।

কেন এক্সিম-পদ্মা সবার আগে?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। দুই ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের যৌথ ব্যবসা থাকায় প্রথম এই ব্যাংক দুটিকে বেছে নেওয়া হয়। এই একীভূতকরণের উদ্যোগের ফলে আর্থিক বাজারে কোনো অস্থিরতা তৈরি না হলে আগামী দিনে অন্য দুর্বল ব্যাংকগুলোর বিষয়েও একই ধরনের সিদ্ধান্ত হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “সরকারের উপরের মহলের নির্দেশেই দুর্বল পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে সবল এক্সিম ব্যাংক একীভূত হচ্ছে।

“কেননা, এর আগে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংককে টেনে তুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক ও আইসিবি যে বিনিয়োগ করেছিল, তা সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই করেছিল।”

সেই উদ্যোগেই ফারমার্স ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়।

একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া কী?

এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বৃহস্পতিবার আলাদা আলাদা সভায় একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, কীভাবে একীভূত হবে, দায়-দেনা কীভাবে সমন্বয় হবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা ও পরামর্শক্রমে দুই ব্যাংকের আইনজীবী মিলে ঠিক করবেন।

তিনি বলেন, “এজন্য আগামী সোমবার একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। ওই চুক্তির পর একীভূত কার্যক্রমের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে শিগগিরই একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নীতিমালার আওতায় একীভূত হওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

পদ্মা ব্যাংকের কী হাল?

২০১৩ সালের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন পায় ফারমার্স ব্যাংক। তখন ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

সেই প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং তা ঘটে ব্যাংকটি কার্যক্রম শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই।

এরপর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন নাফিজ সরাফাত। তিনি মাস খানেক হলো পদত্যাগ করেন।

২০১৭ সালে এ ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি একাধিক ব্যাংক ও সংস্থা। ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি।

এক্সিম ব্যাংকের কী হাল

এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে এটি ইসলামী ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১০ টাকা। এদিন ব্যাংকটির শেয়ারের দাম ১ শতাংশের মতো বেড়েছে।

একীভূত হলে নাম কী হবে?

দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বসে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু দুর্বল পদ্মা ব্যাংক সবল এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে, তাই নাম এক্সিম ব্যাংকই হবে।

আমানতকারীদের কী হবে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আমানতকারীদের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না। পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদের কোনও সমস্যা হবে না। তারা নীতিমালার আলোকে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক ও আমানতকারী হয়ে যাবে।

তবে পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকদের নতুন করে চেক বই নিতে হবে বলে জানান কেন্দ্রীয় ওই কর্মকর্তা।

এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদ্মা ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা কিনে নেবে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। ফলে যে কারণে ব্যাংকটির সম্পদের (ঋণ ও বিনিয়োগ) মান খারাপ হয়ে পড়েছে, তা আর থাকবে না।

এর আগে মিলেছিল কোন দুটি ব্যাংক?

বাংলাদেশে এর আগে ২০১০ সালে শুধু দুটি ব্যাংক একীভূত হয়েছিল। সেই দুটি ব্যাংক হচ্ছে- বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। একীভূতকরণের পর এটি এখন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে চলছে।

সেই দুটি ব্যাংকই ছিল সরকারি ব্যাংক। দুটি ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এক হয়ে যাওয়ার পরও অবশ্য ভালো চলছে না।

একীভূত হলেই কি সংকট কাটে?

একীভূত হলেই যে ব্যাংক ভালো হয়ে যাবে বা ভালোভাবে চলবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই।

শিল্প ব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত হওয়ার পর উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমঝোতামূলক মনোভাব নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকে নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আবার একীভূত হওয়ার পরও দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেমন ছিল, তা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হয়নি। এখনও ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে একীভূতকরণের উদ্যোগটি সমর্থন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী।

তবে তিনি একই সঙ্গে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটাও মনে রাখতে হবে যে, যেসব ব্যাংক একীভূত হবে, তারা যেন আগের তুলনায় ভালো চলতে পারে, অধিকতর শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”

“দুর্বল ব্যাংকটির ভারে সবল ব্যাংকটিও যেন দুর্বল হয়ে না পড়ে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে,” বলেন মোস্তফা মুজেরী।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত