আদায়ের সম্ভবানা খুবই কম এমন খেলাপি ঋণ এককালীন পরিশোধের সুযোগ দিয়ে ‘এক্সিট নীতিমালা’ জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই নীতিমালার আওতায় খেলাপি গ্রাহকের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে অথবা ঋণগ্রহীতা কর্তৃক প্রকল্প বা ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষেত্রে নিয়মিত ঋণ গ্রাহকও এক্সিট সুবিধা নিতে পারবে।
এক্সিট সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণ সমন্বয়ের আগে ঋণের বিপরীতে গৃহীত জামানত অবমুক্ত করা যাবে না। তবে, ব্যাংক, গ্রাহক ও ক্রেতা আগ্রহী হলে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আলোচ্য ঋণের বিপরীতে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করা যাবে।
এ ধরনের এক্সিট সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের বিপরীতে যথানিয়মে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
সোমবার (৮ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এই নীতিমালা জারি করে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের পাঠানো হয়।
এতদিন এক্সিট সম্পর্কিত স্থায়ী কোনও নীতিমালা ছিল না। তবে ২০১৯ সালের ১৬ মে সহজ শর্তে পুনঃতফসিল ও এক্সিটের একটি সুবিধা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদ দিয়ে এক্সিট সুবিধা পাওয়া যেতো। ওই নীতিমালা বাস্তবায়নের সময়সীমা কয়েক দফা বাড়ানো হলেও পরবর্তীতে তা আর কার্যকর ছিল না।
একারণে স্থায়ী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংস্থাটি বলছে, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনও কখনও বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কারণে বন্ধ হয়ে যায়। অথবা লোকসানে পরিচালিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা হতে গ্রাহকের অন্তর্মুখী নগদ প্রবাহ বন্ধ কিংবা কিস্তি পরিশোধের জন্য নগদ প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ আদায় বাধাগ্রস্ত হয়।
এক্সিটের আওতায় ঋণ আদায় বা সমন্বয় সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো এক্সিটের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এ কারণে এরূপ সুবিধা প্রদানে একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের আবশ্যকতা পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়, বিদ্যমান ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদে পরিশোধ করে এক্সিট সুবিধা প্রাপ্তির আবেদন করতে হবে। ঋণগ্রহীতার আবেদন প্রাপ্তির দুই মাসের মধ্যে ব্যাংক কর্তৃক তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা নির্বাহী কমিটি কর্তৃক এক্সিট সুবিধা অনুমোদিত হতে হবে। তবে, মূল ঋণ অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত এক্সিট সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উপর অর্পণ করতে পারবে ব্যাংক।
এক্সিট সুবিধার আওতায় এক বা একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিশোধসূচি প্রণয়ন করতে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাধারণভাবে ২ বছরের বেশি হবে না বলে উল্লেখ করা হয় নীতিমালায়। তবে, পরিচালনা পর্ষদ যুক্তিসঙ্গত কারণ বিবেচনায় সর্বোচ্চ আরও ১ বছর সময় বৃদ্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৩ বছরে ঋণটি পরিশোধের সুযোগ পাবে গ্রাহক।
এ সুবিধার আওতায় সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে মওকুফযোগ্য সুদ পৃথক ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে এবং সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের পর ব্লকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসেবে গণ্য হবে।
এক্সিট সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির ঋণের দায় সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত এক্সিট পূর্ববর্তী ঋণের শ্রেণিমান আগের মতোই থাকবে। খেলাপি ঋণগ্রহীতারা যথানিয়মে খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত হবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে।
নীতিমালার এই সিদ্ধান্তগুলো এক্সিট সংক্রান্ত সুবিধা প্রদানকে সহজ করবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা একেক ব্যাংক একেকভাবে এই সুবিধাগুলো দিচ্ছিলাম। এখন সবার জন্য একই নীতিমালা জারি করায় সব গ্রাহক একই ধরনের সুযোগ পাবেন। কোনও গ্রাহক বাড়তি সুবিধাও দাবি করতে পারবে না।”
নীতিমালা অনুযায়ী, এক্সিট সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে ওই ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের আগে কোনোরূপ নতুন ঋণ সুবিধা দিতে পারবে না ব্যাংক। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক অবলোপনকৃত ঋণ এক্সিট সুবিধার আওতায় আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।
এক্সিট সুবিধা প্রাপ্তির পর গ্রাহক পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ আদায়ে ব্যাংক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে বলেও উল্লেখ রয়েছে নীতিমালায়।
ইসলামী শরীয়াহ্ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো এই নীতিমালা অনুসরণ করে তাদের নিয়মিত ও বিরূপমানে শ্রেণিকৃত বিনিয়োগ আদায় বা সমন্বয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এ নীতিমালা এক্সিট প্রদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। এ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংকগুলো এক্সিট সংক্রান্ত নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করবে, যা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হবে। ব্যাংক কর্তৃক প্রণীতব্য নীতিমালায় এ সার্কুলারে বর্ণিত শর্তাদির চেয়ে নমনীয় কোনও শর্ত যুক্ত করা যাবে না।