ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড গাজা দখলে নেওয়ার একটি ‘উদ্ভট’ পরিকল্পনা হাজির করলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে এই েঘাষণা দেওয়ার পর তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবাদ হচ্ছে, ডেমোক্রেটরা তুলেছেন আপত্তি। ইসরায়েলের ডানপন্থিরা এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও আরব দেশগুলো এর বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে।
এর মধ্যেই আরব কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি বিভ্রান্তিকর।
একজন কূটনীতিক সিএনএনকে বলেছেন, গাজা দখল করা কিংবা এটি হজম করা কঠিন হবে।
বর্তমানে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভেতর যে দুটি অংশ নিয়ে ফিলিস্তিন, তার পশ্চিম অংশটি হলো গাজা। ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত গাজায় মানুষের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এর ৯৯ শতাংশই মুসলমান।
দুটি অংশের মধ্যে বৃহৎ অংশ পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গাজার নিয়ন্ত্রণকর্তা চরমপন্থি দল হামাস। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি অভিযানে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা এখন অন্য কারণে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠল।
আবাসন ব্যবসা দিয়ে ধনকুবের হয়ে ওঠা ট্রাম্প ভূমধ্য সাগর কূলের গাজাকে ‘মিডল ইস্ট রিভেইরা’ হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছেন। অর্থাৎ স্পেন ও ফ্রান্সের সাগরতটের নগরগুলোর মতো চাকচিক্যময় শহর হবে সেখানে।
গাজা নিয়ে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে ট্রাম্প বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এলাকাটি বদলে দেবেন তিনি, সেখানে নতুন নতুন ভবন উঠবে, হবে নতুন কর্মসংস্থান।
এজন্য গাজার বর্তমান বাসিন্দাদের অন্য স্থানে সরিয়ে নিলেও পরিকল্পিত শহরে বিশ্বের অন্য সব দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিরাও থাকতে পারবে।
গাজা হজম করা কঠিন বলছেন যিনি, সেই কূটনীতিক বলেন, এই পরিকল্পনার একটি ব্যাখ্যা থাকা দরকার। আর পরে কী হবে, তাও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
আরেক আরব কূটনীতিক বলেছেন, আড়াই বছরের লড়াইয়ের পর যখন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে, তখন ট্রাম্পের পরিকল্পনা পুরো প্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে পারে।
তিনি বলেন, এটা কেবল ফিলিস্তিনি জনগণের বেঁচে থাকা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই একটি বড় ব্যাপার।
গাজায় হামাসের নেতা সামি আবু জুহরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনাকে হাস্যকর ও উদ্ভট আখ্যা দিয়ে রয়টার্সকে বলেন, “এ ধরনের যেকোনো চিন্তা এই অঞ্চলে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।”
আরব এক কূটনীতিক সিএনএনকে বলেন, এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবে, কেননা গাজার বাসিন্দারা নিিশ্চতভাবেই তা প্রতিরোধে নামবে এবং ওই ভূখণ্ড ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাবে।
গাজার সাংবাদিক তারিক দাহলান বিবিসিকে বলেন, “অন্য সব দেশের মতোই গাজার মানুষ এখানেই থাকতে চাইবে। কারণ এখানেই তাদের জন্ম, তাদের বেড়ে ওঠা এখানেই।
“আমরা এই ভূখণ্ডের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এখান েথকে সরিয়ে নেওয়ার যেকোনো পরিকল্পনার বিরোধিতা করব আমরা।”
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরবও এই ধরনের পরিকল্পনায় সায় দেবে বলে মনে হয় না, সিএনএনকে বলেন এক কূটনীতিক।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির পক্ষ থেকেও এটাও পুনর্বার বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না তারা।
ফিলিস্তিনিদের শত বছরের সংকট অবসানে দ্বি রাষ্ট্র সমাধানের পথ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে বহু কাল। এই প্রস্তাবে সেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটি রাষ্ট্র থাকবে।
পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, তার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিদের কাছে পবিত্র নগরী জেরুজালেম ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।
দুই রাষ্ট্রের প্রস্তাব ইসরায়েল মানতে নারাজ। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই প্রস্তাব মানলেও হামাস তা মেনে নিতে রাজি নয়। কারণ এই দলটি ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নারাজ।
১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোয় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি হলেও তা বারবার বাধার মুখে পড়ছে। আর সেজন্য দুই পক্ষ একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে। যুদ্ধও বাঁধছে উভয় পক্ষে।
ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা হাজিরের পর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ যুক্তরাজ্যও তাতে সমর্থন দিচ্ছে না। সেখানে সঙ্কট অবসানের পথ হিসাবে দ্বিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকেই দেখার কথা জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড লামি। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমি গাজা ও পশ্চিম তীরে বসবাস করছে, আমরা সেটাই দেখতে চাই।”
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জোরপূর্বক কাউকে গাজা থেকে উৎখাতের বিরোধিতা করছে। সেই সঙ্গে বলেছে, ওই এলাকাটি তৃতীয় কোনও পক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ হবে না। ফরাসি সরকারও মনে করছে, মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের একমাত্র সমাধান দুই রাষ্ট্র বাস্তবায়ন।
রাশিয়াও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে জোর দিচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ একথা জানান রয়টার্সকে। চীন ও অস্ট্রেলিয়াও অন্য সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্বি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের সমাধান চাইছে।
যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটভুক্ত রাষ্ট্র তুরস্কও ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাতের পরিকল্পনা আরও সংঘাত ডেকে আনবে।
বাইরে বিরোধিতা তো চলছে, দেশের ভেতরেও নিজের গাজা পরিকল্পনা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ট্রাম্প; এমনকি তার নিজ দল থেকেও।
সাইথ ক্যারোলাইনা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সেনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, “আমাদের আরব বন্ধুরা কী বলছে, তা আমরা দেখব। আমার মনে হয়, সাউথ ক্যারোলাইনার অধিকাংশ মানুষ গাজা দখলে আমেরিকানদের পাঠানোতে সায় দেবে না।”
ট্রাম্প যখন গাজা দখলের পরিকল্পনার কথা বলছিলেন, তখন তার পাশে থাকা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মিটমিটিয়ে হাসছিলেন।
পরে তিনি বলেন, “ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ইতিহাস বদলে দেবে। সন্ত্রাসের চারণভূমি হয়ে ওঠা গাজার নতুন ভবিষ্যতের পথ করে দেবে।
ট্রাম্পের ঘোষণা শুনে খুশি হয়েছে ইসরায়েলের চরমপন্থি দল জুইশ পার্টি। এই দলটির নেতা ইতামার বেন বির তার দেশের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।
তিনি এক্স এ লিখেছেন, “এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মূল সমস্যাটি গাজা, সমাধানও সেখানে। এটাই হবে পরবর্তী দিনের কৌশল।”
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করে এক মাস আগেই ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন ইতামার।
অন্যদিকে ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর এক্স এ পোস্ট করা এক ভিডিওতে বলেছেন, যারা তাদেরকে সুখী, সুন্দর একটি স্থানে পাঠাতে চায়, তাদের উচিৎ ইসরায়েলের ভেতরে তাদের মূল বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
‘আমাদের মাতৃভূমি আমাদের মাতৃভূমিই’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, গাজা ফিলিস্তিনিদের ঠিকানা এবং তারা এখানে থাকতে ভালোবাসে।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ হচ্ছে ট্রাম্পের গাজা নিয়ে গাঁজাখুরি পরিকল্পনা নিয়ে। হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ থেকে প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে বলা হয়েছে- ‘ফিলিস্তিন বিক্রির জন্য নয়’।