প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের সব রেকর্ড ভেঙে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়নি।
এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়। ধারণা করা হচ্ছিল, এতে প্রতিবেশী দেশটিতে রপ্তানি আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ১১ মাসে রপ্তানি কমে গেছে ১৫ শতাংশ।
ভারতে কমলেও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে রপ্তানি বেড়েছে। অপ্রচলিত বাজার রাশিয়াতেও বেড়েছে রপ্তানি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। তবে ৫৬ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যের চেয়ে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম।
রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে ভারতের বাজারে ১৬৭ কোটি ৭ লাখ (১.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৯৮ কোটি (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে আয় হয়েছিল ১৮৩ কোটি ৪৩ লাখ (১.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।
অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে চীনে ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ১১ মাসে ৬১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল চীনে।
ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৯ কোটি ২ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৩%
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭২ কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এই ১১ মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় গত অর্থবছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
গত চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি আয় হয়। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১২৫ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয় ভারত; যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ওই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
গত কয়েক বছরে ভারতে রপ্তানি আয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়ায়। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।”
এখন তা কমে গেল কেন- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ার কারণে ভারতে রপ্তানি বাড়ার কথা। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো কমছে। এর কারণ সরকার ও রপ্তানিকারকদের খুঁজে বের করতে হবে।”
সেলিম এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, “ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ‘কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা)’ স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে পরে আর কোনও অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে।
ভারতে রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ খুুঁজে পাচ্ছেন না তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজও।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল। দেড়শ’কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।
“আমাদের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। কোথায় দুর্বলতা আছে; কী করতে হবে-তা দ্রুত করতে হবে।”
তৈরি পোশাক ছাড়া ভারতে অন্য যে সব পণ্য রপ্তানি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- পাট ও পাটজাতপণ্য, কটন ও কটন প্রোডাক্টস, প্লাস্টিক দ্রব্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য।
চীনে বেড়েছে ২৩%, রাশিয়ায় ১৫%
চীনের বাজারে রপ্তানি বেশ ভালো গতিতেই বাড়ছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশটিতে ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি।
জুলাই-মে সময়ে চীনে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩১ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই ১১ মাসে চীনের বাজারে ৬১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছিল ৩০ কোটি ডলারের মতো।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৯ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৬ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এই বাজারে ৪৩ কোটি ২৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। ওই ১১ মাসে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৪০ কোটি ডলার।
সম্ভাবনাময় এই বাজারে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ানোয় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তৈরি পোশাকের খুবই সম্ভাবনা এবং ভালো বাজার হয়ে উঠছিল রাশিয়া। অনেক দিন চেষ্টার ফলে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম ২০২২-২৩ অর্থবছরেই দেশটিতে আমাদের রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার অতিক্রম করবে।
“কিন্তু যুদ্ধের কারণে সে আশায় হোঁচট খায়। রপ্তানি অনেক কমে যায়। এখন আবার বাড়ছে। যুদ্ধ থামেনি; এর মধ্যেও রপ্তানি বাড়া খুবই ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে। আশা করছি, রাশিয়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির আশা শিগগিরই পূরণ হবে।”
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তা ধাক্কা খায়। শেষ পর্যন্ত ৪৬ কোটি ডলার আয় হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন রপ্তানিকারকরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায়। এর পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে থাকে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর জুড়েই সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়তে থাকে। ওই অর্থবছরে দেশটিতে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়ে সেই রপ্তানি ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার ডলারে গিয়ে উঠে, যা ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।