গত ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারের উপরে। মার্চ মাসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এনিয়ে টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলার বা ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এল, এমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি।
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রপ্তানির এই চিত্র দেখে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এই ধারা ধরে রাখলে রিজার্ভের ওপর চাপ অনেকটাই কেটে যাবে।
তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবির) এই তথ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের একটি সংগঠনের নেতা মোহাম্মদ হাতেম।
ইপিবি মঙ্গলবার হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মার্চ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ৫১০ কোটি ২৬ লাখ (৫.১০ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে।
এই অঙ্ক গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৫১৪ কোটি (৫.১৫ বিলিয়ন) চেয়ে শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ৪৬৪ কোটি ৩৯ লাখ (৪.৬৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল।
গত বছরের নভেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। এরপর জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার আসে রপ্তানি থেকে, যা একক মাসের হিসাবে এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি।
ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আয় কিছুটা কমলেও ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামেনি। সে মাসে ৫১৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলার এসেছিল।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি ৪৮ লাখ (৪৩.৫৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।
এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি হলেও এবারের ৪৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই নয় মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
গত বছর অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।
অক্টোবরের রপ্তানি আয় ছিল ২৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। তার আগে ২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন দেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
তবে অক্টোবরের পর থেকে রপ্তানি আয় বাড়তে থাকে।
৮৫ শতাংশই পোশাক থেকে
জুলাই-মার্চ সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৬ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
এই নয় মাসে পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির হিসাব বলছে, জুলাই-মার্চ এই নয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ৪১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা ভালো যে, টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
“কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা এখনও লেগে আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে।”
এর মধ্যে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনও চিন্তিত ফারুক।
নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ইপিবির তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ইপিবির তথ্যের সঙ্গে আমরা আমাদের রপ্তানির তথ্যের মিল খুঁজে পাচ্ছি না।
“আমাদের সবার রপ্তানি কমছে, আমরা কেউ ভালো নেই। অথচ ইপিবি বলছে, রপ্তানি বাড়ছে! ইপিবির তথ্য নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে।”
আগামী দিনগুলো কেমন যাবে বলে মনে করেন- প্রশ্নে হাতেম বলেন, “ভালো যাওয়ার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গ্যাস সংকট লেগেই আছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো না। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি বাড়ার আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।”
এদিকে অর্থনীতি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই সংকটের সময় রপ্তানি আয় বাড়া স্বস্তির খবর। এই আয় রিজার্ভের পতন ঠেকাতে সহায়তা করবে।”
তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে এই ইতিবাচক ধারা যাতে আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকে, তার ওপর নজর দিকে রপ্তানিকারক ও সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
“মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় যদি কমে যেত, তাহলে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু আরও কমে যেত। তাতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ত। তাই আমি মনে করি, রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স যেন বাড়ে, সেদিকেই সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ।”
অন্যান্য খাত
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-মার্চ) হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৬ শতাংশ।
তবে এই নয় মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।