রপ্তানির তথ্য সংশোধনের ফলে প্রবৃদ্ধিতে থাকা রপ্তানি আয় নেতিবাচক হয়ে গেছে। আর এতে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হিসাবনিকাশ ওলোটপালট হয়ে গেছে।
রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার। রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের (জুলাই-মে) রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করেছে।
তাতে দেখা যায়, এই ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৭২ কোটি ৯০ লাখ (৪০.৭৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কম।
অথচ গত সপ্তাহে (৪ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো হিসাবে রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তাতে গেল অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার আয়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে ওই ১১ মাসে ২ দশমিক শূন্য এক শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রপ্তানি আয় ১ হাজার ৮১ কোটি ৩৭ লাখ (১০.৮১ বিলিয়ন) ডলার কমে গেছে।
পুরনো হিসাবে আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) এই ১১ মাসে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৭২ লাখ (৫০.৫২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সংশোধিত হিসাবে তা ৭ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার কমে ৪২ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
সংশোধিত হিসাবে বিশাল অঙ্কের এই রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারও কমে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এর আগেই নতুন হিসাবে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওলোটপালট হয়ে যাওয়ার তথ্য দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩ জুলাই বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানির ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করে। সেখানে ইপিবির প্রকাশ করা তথ্যের সঙ্গে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ফারাক পাওয়া যায়। এর পর থেকে রপ্তানির তথ্যের গরমিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এনবিআর ও ইপিবির ‘ভুলে’ রপ্তানি হিসাবে গরমিল
রপ্তানি আয়ের হিসাবে ব্যাপক গরমিলের ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ওপর দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ৪ জুলাই অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লেখা চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডলার-সংকটের কারণে দেশের লেনদেন ভারসাম্য বড় চাপে পড়ে। দীর্ঘদিন পর লেনদেন ভারসাম্যের আর্থিক হিসাব ঘাটতিতে পড়ে যায়। এই ঘাটতি তৈরি হয় রপ্তানি যে পরিমাণ হচ্ছে, সেই পরিমাণ আয় দেশে না আসায় এবং আমদানি বিল যে পরিমাণে পরিশোধ হচ্ছে, সেই পরিমাণ পণ্য দেশে না আসায়। এই ঘাটতি বড় হতে থাকায় প্রকৃত অবস্থা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও ইপিবি মিলে কমিটি গঠন করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করা হয়।
এক সভায় এনবিআরের প্রতিনিধি সরবরাহকৃত রপ্তানির ডেটাসেটে একাধিকবার রপ্তানির হিসাব থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি আয়ের তথ্য-উপাত্ত তফসিলি ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে সংগ্রহ করে থাকে। ফলে সেই তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে প্রকৃত রপ্তানির তেমন পার্থক্য থাকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগ্রহ ও ইপিবি প্রকাশিত রপ্তানিসংক্রান্ত তথ্যে পার্থক্য থাকার কারণগুলো চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, একই রপ্তানি তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেওয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং এবং ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল হিসাব হওয়ার কথা। কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। ইপিবি অনেক সময় নমুনা পণ্যের দামও ইনপুট দিয়েছে। অথচ নমুনা পণ্যের কোনও দাম হিসাবে আসার কথা নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানি হিসাবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানির সময়ও হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত পণ্য রপ্তানির সময় রপ্তানির প্রাথমিক ঋণপত্র (এলসি) মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এ ছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবির হিসাবে সমন্বয় হয় না।
ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক, ইপিবি, এনবিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি ব্যয়, রপ্তানি আয়, অদৃশ্য ব্যয়, অদৃশ্য আয়, রেমিট্যান্সের তথ্য মাসিক ভিত্তিতে সংগ্রহ করে লেনদেন ভারসাম্যের বিবরণী প্রস্তুত করে থাকে। সাম্প্রতিককালে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসা কমে যাওয়ায় ট্রেড ক্রেডিট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূলত রপ্তানি (শিপমেন্ট) ও প্রকৃত রপ্তানি আয়ের ব্যবধানের কারণে হয়ে থাকে।
চিঠিতে বলা হয়, আর্থিক হিসাবে প্রকৃত ট্রেড ক্রেডিট বলতে রপ্তানি (শিপমেন্ট) ও রপ্তানি আয়ের পার্থক্য এবং আমদানি (শিপমেন্ট) ও আমদানি ব্যয়ের পার্থক্যের যোগফল বোঝানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সংশোধিত ডেটাসেট ব্যবহার করার কারণে লেনদেনের ভারসাম্যের বিবরণীতে ট্রেড ক্রেডিটসহ চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব সংশোধিত হয়েছে। তবে এর জন্য সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, চলতি হিসাবে থাকা উদ্ধৃত্ত সংশোধিত হয়ে আর্থিক হিসাবে সমন্বয় হয়েছে।
জুনের রপ্তানির তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি কেউ
৩০ জুন শেষ হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের ১১ দিন চলে গেছে। তবে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনের পণ্য রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেনি ইপিবি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জুন মাসের রপ্তানির কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এতদিন ইপিবির সরবরাহ করা তথ্য গ্রহণ করত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইপিবি প্রতি মাসের রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত চলমান মাসের ১ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে আগের মাসের রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। কোনও কোনও মাসে ১ তারিখেও আগের মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে ইপিবি।
কিন্তু জুলাই মাসের ১১ দিন পার হয়ে গেলেও জুন মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কবে প্রকাশ করা হবে- তাও নিশ্চিত করতে পারছেন না সংস্থাটির কোনও কর্মকর্তা।
এবার রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে কেন- এ বিষয়ে জানতে বুধবার সন্ধ্যায় ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে এসএমএস করা হলেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইপিবির এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রপ্তানি তথ্যের গরমিল ধরা পড়ায় ইপিবি তথ্য বাছাই করছে। এজন্য এ মাসে একটু দেরি হচ্ছে।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, “রপ্তানি তথ্যে অসংগতির যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে, তা সবই ঠিক আছে। আমাদের দেশ থেকে দুইভাবে পণ্য রপ্তানি হয়। এর একটি হচ্ছে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র)। প্রথমে কাপড় ও সুতা আমদানি করা হয়, তারপর রপ্তানি করা হয়। এখানে মোট মূল্য এক্সপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। আবার কাপড় ও সুতা বিনা মূল্যে ক্রেতারা (বায়ার) পাঠিয়ে দেয়। ওই পণ্য যখন রপ্তানি হয়, তখন ক্রেতারা আমাদের শুধু সিএমটি (কাটিং, মেকিং অ্যান্ড ট্রিমিং) পেমেন্ট করে।”
তিনি বলেন, “আমরা (ইপিবি) এতদিন পুরো রপ্তানি মূল্য দেখিয়েছি। আর এনবিআর বায়াররা যে কাপড় ও সুতা পাঠান- তা বাদ দিয়ে রপ্তানির হিসাব করে। সে কারণেই ইপিবি ও এনবিআরের হিসাবে বড় গড়মিল হয়েছে।”
ওই কর্মকর্তা জানান, গত সোমবার ৮ জুলাই ইপিবিতে এ বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিসংখ্যান ব্যুরো, এনবিআর, ইপিবি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলন, বৈঠকে ভবিষ্যতে এমন অসংগতি এড়াতে সবাই একটি মানদণ্ড ঠিক করে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।
সেই মানদণ্ড অনুযায়ী কয়েক দিনের মধ্যেই জুন মাসের রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত ৩ জুলাই বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের তথ্য নতুনভাবে প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে ওলোটপালট হয়ে গেছে হিসাব।