Beta
শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪

মুগ্ধের মায়ের নামে ছড়াচ্ছে ভুয়া খবর, দাবি পরিবারের

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের রেশ এখনও দেশজুড়ে। শহরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা চিত্রগুলো প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে তীব্র প্রতিরোধ আর আন্দোলনের কথা।

ঢাকার দেয়ালচিত্রগুলোয় সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে সম্ভবত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পুলিশের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানোর ছবি। যে চিত্র আন্দোলনের প্রতীকও হয়ে উঠেছিল একসময়।

এরপরই দেখা মিলবে পানির বোতল হাতে মুগ্ধের ছবি, পাশেই লেখা থাকবে ‘পানি লাগবে, পানি?’ কিংবা স্রেফ একটি পানির বোতলের ছবি এঁকে তার পাশে লিখে দেওয়া হয়েছে একই ক্যাপশন।

কে এই মুগ্ধ

পুরো নাম মীর মাহফুজুর রহমান, ডাক নাম মুগ্ধ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)। থাকতেন ঢাকার উত্তরায়।

গত ১৮ জুলাই মুগ্ধের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে দেখা যায়, রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ছুড়ছে কাঁদানে গ্যাস। সেই গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে কোনোমতে এক চোখ খুলে হাঁটতে হাঁটতে আন্দোলনকারীদের কাছে পানি বিতরণ করছিলেন মুগ্ধ। বলছিলেন, “কারও পানি লাগবে, পানি?”

এর কিছুক্ষণ পরেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মুগ্ধ।

মুগ্ধের মৃত্যুর পর তার পানি বিতরণের ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। রাজপথে লেগে থাকা তার রক্তের ছবিও হয় ভাইরাল। আবু সাঈদের ভিডিও যেমন আন্দোলনে গতি দিয়েছিল, তেমনি মুগ্ধের ভিডিও মানুষের মধ্যে ক্রোধ তৈরি করে, আন্দোলনে উদ্দীপনা জোগায়।

মুগ্ধের মায়ের নামে ভুয়া খবর, যা বলছে পরিবার

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেসময় নিউ ইয়র্কে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’র এক আয়োজনে বক্তব্য দেন তিনি।

বক্তব্যের এক পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই আন্দোলনে হঠাৎ করে কিছু হয়নি। পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনকে তিনি ‘অ্যামেইজিং মেটিকুলাসলি ডিজাইনড থিং’।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে স্নিগ্ধ

প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ফটোকার্ড ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে লেখা ছিল, “মেটিকিউলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবে আমার ছেলের লাশটা তাদের দরকার ছিল : মুগ্ধর মা”

এই বক্তব্য ও এই বক্তব্য সম্বলিত ফটোকার্ড ভাইরাল হলে মুগ্ধের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সকাল সন্ধ্যা। তারা জানান, এটি ভুয়া খবর। মুগ্ধের মা গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি, এ ধরনের কোনও কথাও তিনি কারও কাছে বলেননি।

মুগ্ধের জমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, মায়ের নামে ছড়িয়ে পড়া খবরটি ভুয়া এবং তারা সেটির প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

তিনি বলেন, “কার্ডটি আমাদের চোখেও পড়েছে। এটা ফেইক নিউজ। আমাদের মা মিডিয়ার সামনে এখনও আসেনি। আমি এটা ক্লিয়ার করছি। এটা ফেইক। মা কারও সঙ্গে কথা বলেননি।”

এসবে বিভ্রান্ত না হতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্নিগ্ধ বলেন, “মুগ্ধসহ সব শহীদদের জন্য আপনারা দোয়া করবেন।”

বন্ধুর বয়ানে মুগ্ধের মৃত্যু

জুলাইয়ের শুরু থেকেই দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। যার নেতৃত্ব দিচ্ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয় জনের মৃত্যুর পর আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পথে নেমে আসে শিক্ষার্থীরা, পুলিশি বাধা উপেক্ষা করেই চলতে থাকে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ।

তখন ১৮ জুলাইয়ের শেষ বিকেল। ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো উত্তাল ছিল উত্তরাও। প্রধান সড়ক ছাড়িয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়েছিল অলিগলিতে, পাড়া-মহল্লায়।

বিবিসি বাংলাকে মুগ্ধের বন্ধু জাকিরুল ইসলাম দিয়েছেন সেদিনের বর্ণনা। মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় জাকিরুল তার কাছাকাছিই ছিলেন।

বন্ধুর কপালে গুলি লাগার দৃশ্য বর্ণনা করে তিনি বলেন, “গুলি লাগছিলো কপালে, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে…ডান কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে।

 “গুলি লাগার পর ওর মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছিল। ঘটনাস্থলেই, আমাদের চোখের সামনেই ও মারা গেল।”

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ড ও বক্তব্য ভুয়া বলে জানিয়েছে মুগ্ধের পরিবার।

মুগ্ধ সবাইরে পানি দিচ্ছিলেন জানিয়ে জাকিরুল বলেন, “আমাদের কাছে না ছিল কোনও ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, না ছিল অন্য কোনোকিছু। তারপরও এইভাবে আমার বন্ধুরে গুলি করে মাইরা ফেলাইলি? আমার সামনে ঘটে যাওয়া এ সিন আমি কীভাবে ভুলি?”

মুগ্ধর রক্তে ভেসে যাওয়া সেই রাস্তার ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলেন তারই আরেক বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। তিনিও ছিলেন সেই মৃত্যুর সাক্ষী।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে আশিক লিখেছেন তিনি, মুগ্ধ ও তাদের বন্ধু জাকির আন্দোলনের মাঝেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রোড ডিভাইডারের ওপর বসেছিলেন।

তিনি বলেন, “হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীরগতিতেই উঠব ভাবলাম! দুই-তিন সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম, চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বলল, চল!”

তার বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথমে জাকির উঠে দৌড় দিলেন এবং তারপর তিনি।

নাইমুর বলেন, “কিন্তু তিন থেকে চার কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখছি দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নেই!

“থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম – জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইসে!”

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন

ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের স্মৃতি ধরে রাখতে গত ১২ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের ৭ সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। যার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

মূলত আন্দোলনে নিহতদের স্মৃতি ধরে রাখা, গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা এবং আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করাই ফাউন্ডেশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য। এতে ব্যক্তিপর্যায়ে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছ থেকেও সহযোগিতা নেওয়া হবে। সরকারও এ ফাউন্ডেশনে অর্থ দেবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত