মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বডিবিল্ডার ফারুক হোসেনকে, এমন দাবি করে তার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। সেই মামলায় সাক্ষী করা হয় দুই যুবককে। তবে তাদের কথায় দেখা যাচ্ছে অসঙ্গতি। এই সাক্ষীদের একজন আবার পুলিশেরই সোর্স হিসেবে পরিচিত।
ফারুকের স্ত্রী ঈমা আক্তার হ্যাপীর অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে কারা হেফাজতে মারা গেছেন তার স্বামী। পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেছেন তিনি।
নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত চলছে বলে এনিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
এক সময়ের ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ ফারুকের (৫৪) বাসা পুরান ঢাকার চকবাজার থানার খাজে দেওয়ান সড়কে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার।
গত ১২ জানুয়ারি রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে বংশাল থানার কয়েতটুলী ফাঁড়ির পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। পরদিন আদালতের মাধ্যমে তাকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
অসুস্থ অবস্থায় ১৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে সেদিনই মারা যান তিনি।
সিটি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শোয়েবের সাবেক দেহরক্ষী ফারুক সর্বশেষ ইস্টার্ন ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিং ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
যা রয়েছে এজাহারে
ফারুককে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা করেন বংশাল থানার এসআই ইমদাদুল হক, যিনি কয়েতটুলী ফাঁড়ির দায়িত্বে ছিলেন।
সেই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এক মাদক ব্যবসায়ী মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে- গোপন সূত্রে পাওয়া এমন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি রাত ১১টা ২০ মিনিটে নাজিমউদ্দিন রোডের হাসিনা মঞ্জিলের সামনে অভিযানে যান এসআই ইমদাদুল হক, এএসআই মাসুদ রানা ও এএসআই বুলবুল আহমেদ।
“এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে ওই মাদক ব্যবসায়ী (ফারুক)। এক পর্যায়ে সঙ্গীয় অফিসারদের সহায়তায় ওই আসামিকে আটক করেন ইমদাদুল হক।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষী মো. সুজন ও মো. সাগরসহ পুলিশ সদস্যদের সামনে ফারুকের হাতে থাকা শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা মূল্যের আড়াইশ গ্রাম গাঁজা জব্দ করা হয় বলে দাবি করা হয় মামলায়। রাত পৌনে ১টার দিকে জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
মামলায় বলা হয়, ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য বিক্রি করে আসছিলেন ফারুক।
সাক্ষীদের কথায় অসঙ্গতি
পুলিশ যাদের সাক্ষী করেছে, তাদের একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য আসছে সংবাদমাধ্যমে, তাতে বেরিয়ে আসছে অসঙ্গতি।
কী ঘটেছিল- এজাহারের দুই নম্বর সাক্ষী মো. সাগরের (২২) কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোন ফারুক? যে লোকের কাছে গাঁঞ্জা পাইছিল সেইটা।”
ফারুকের কাছে গাঁজা দেখেছিলেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে বলেন, “হ্যাঁ, ব্যাগে দেখেছি।”
গাঁজা দেখেছেন, না ব্যাগ- এমন প্রশ্নে এই যুবক ইতস্তত হয়ে বলেন, “ব্যাগ দেখেছি।”
সাগর এর আগে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, সেই রাতে বাসায় ফেরার সময় হাসিনা মঞ্জিলের সামনে পুলিশ তাকে তল্লাশির নামে হেনস্তা করার পর, বাবার নাম, মায়ের নাম আর আমার নাম-ঠিকানা লিখে একটি সাদা কাগজে সই নেয়। তিনি যে সাক্ষী, তাও তার জানা ছিল না।
তার সেই কথার সত্যতা মেলে স্থানীয়দের কথায়ও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার এক ব্যবসায়ী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সেদিন শুধু ফারুকই নয়, কয়েকজনকে তল্লাশির নামে হেনস্তা করেছিল পুলিশ।
ওই রাতে কোথায় যাচ্ছিলেন- সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে সাগর বলেন, চকবাজারের দিকে যেতে মানুষের জটলা দেখে দাঁড়ালে পুলিশ তাকে সাক্ষী বানায়।
“আপনি তো বোনের জন্মদিনের বাজার কিনে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন”- তা বলার পর তিনি দ্রুত কথা ঘুরিয়ে বলেন, “হ্যাঁ… হ্যাঁ, বাসায় যাচ্ছিলাম।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ গাঁজা দেখার কথা জানাননি- একথা বলা হলে সাগর কিছুটা বিব্রত হয়ে চুপ থাকেন; পরে বলেন, “আমি কীভাবে বলব বলেন? পুলিশ বলছে সাক্ষি দিয়েছি।”
এতজনের মধ্যে আপনাকে কেন সাক্ষী বানানো হলো- এমন প্রশ্নে এই যুবক বলেন, “পুলিশ আমাকে বললেন, তুমি দেখেছো সাক্ষি দাও। পরে দিয়েছি।”
পুলিশের মামলায় এক নম্বর সাক্ষী সুজনের (২৮) সঙ্গে সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগের চেষ্টা চালালেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোনও ধরছেন না।
সুজন এর আগে একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ফারুককে আটক করার সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। তিনি বংশাল থানার যে এসআইর সোর্স হিসাবে কাজ করেন, তার সঙ্গে অন্য স্থানে ছিলেন। গভীর রাতে থানায় ডেকে নিয়ে তাকে জোর করে সাক্ষী হতে বাধ্য করেন এসআই ইমদাদুল।
সুজনকে পাওয়া না যাওয়ায় তার বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত হতে পারেনি সকাল সন্ধ্যা।
পুরো অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে এসআই ইমদাদুলের মোবাইলে শনিবার অনেকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তদন্তাধীন বিষয় বলে ডিএমপির লালবাগ অঞ্চলের কোনও কর্মকর্তাও কথা বলতে চাননি।
ফারুকের স্ত্রী মামলা করার পর তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ শনিবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা তো দেখেছেন, যখন কোনও ঘটনা ঘটে, আমরা সেটা তদন্ত করি। আর কোনও ঘটনা আদালত যদি আমাদের দেন, সেটা আরও ভালোভাবে দেখি।
“ফারুকের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।”
ফারুকের স্ত্রীর মামলায় আসামি ৫
ঈমা আক্তার হ্যাপী যে মামলা করেছেন, তাতে স্বামীর মৃত্যুর জন্য পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে।
তারা হলেন- বংশাল থানার ওসি মাইনুল ইসলাম, এসআই ইমদাদুল হক, আবু সালেহ, মাসুদ রানা ও বুলবুল আহমেদ।
মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পর গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) হ্যাপী মামলার আবেদন নিয়ে ঢাকার আদালতে যান। পরদিন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেন ডিবিকে। তাদের ২৮ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কারণ ‘ঘুষ না দেওয়া’
হ্যাপীর দাবি, তার স্বামী মাদকাসক্ত ছিলেন না, তার কোনও অসুস্থতাও ছিল না। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের নির্যাতনই তার মৃত্যুর কারণ।
১৫ জানুয়ারি ঢামেক মর্গের ডোমের মাধ্যমে ফারুকের মৃত্যুর খবর পান তার স্ত্রী। মর্গে গিয়ে ফারুকের গলায় ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখার কথা জানিয়েছেন তিনি।
গ্রেপ্তারের দিনই পুলিশ ফারুককে পিটিয়েছিল দাবি করে হ্যাপী বলেন, ১২ জানুয়ারি রাতে বাসা থেকে ফারুক বের হওয়ার ১৫ মিনিটের মাথায় তাকে ফোন করেন।
“আমাকে বলেন, ‘পুলিশ খামোকা আমাকে রাস্তা থেকে ধরেছে। কায়েতটুলী পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসো’।”
এই খবর পেয়ে ২ বছরের ছেলে ফারদিনকে নিয়ে তখনই ফাঁড়িতে ছোটেন হ্যাপী। সেখানে ফারুক তাকে বলেছিলেন, পুলিশ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে।
স্বামীকে ছাড়াতে শিশু সন্তান কোলে নিয়ে পুলিশের হাত-পাও ধরেছিলেন হ্যাপী। তিনি বলেন, তখন তার কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছিল।
তার ভাষ্যে, এক পুলিশ সদস্য তারে কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। তা না দিলে অশালীন প্রস্তাবও দেন। তার একটিতেও রাজি না হওয়ায় ‘মিথ্যা’ মামলা দিয়ে পরদিন আদালতে তোলা হয় ফারুককে।
হ্যাপী জানান, ফারুকের বিরুদ্ধে মাদকের কোনও মামলা নেই।
“মামলা তো দূরের কথা, ফারুক কোনো মাদক গ্রহণও করতেন না। অথচ পুলিশ বলছে, মাদকের ব্যবসা করত আমার স্বামী!”
বাবাকে খুঁজছে ৩ শিশু
ফারুকের তিন ছেলে। সবার বড় আলিফের বয়স ১০ বছর। বাবা আর ফিরবে না, সে কিছুটা বোঝে।
আরিয়ান (৮) কিছুট বুঝলেও ফারদিনের (২) তা বোঝার বয়সই হয়নি।
ফারুকের মৃত্যুর পর তার বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল আলিফের আর্তনাদে।
“বাবা কোথায়? বাবা তো আর বাসায় আসে না। আমাদের কেউ আদর করে না। পুলিশ আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আম্মু পুলিশ আঙ্কেলদের ছেড়ে দিতে বলেছিল, তাও বাবাকে ছাড়েনি।”
২৫ দিন বাদেও বাবার অভাবের কথাই আসছিল তার কথায়। কথা বলতে গিয়ে ভারী হয়ে উঠছিল হ্যাপীর কণ্ঠও।
“এভাবে মানুষ কাউকে মেরে ফেলতে পারে? অবুঝ তিন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা একবারও ভাবল না পুলিশ!”
মামলা করার পর এখন বিচার পাবেন বলে আশা করছেন স্বামী হারানো এই নারী।
“স্বামী মাদক ব্যবসায়ী, এই অপবাদ মাথায় নিয়ে এখন বাঁচতে হবে আমাকে ও আমার সন্তানদের? এই হত্যার বিচার চাই।”